ডেঙ্গু রোগী সামলাতে হিমশিম, কিছু জেলায় স্যালাইন–সংকট
আরও ৮ জনের মৃত্যু। হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি ২ হাজার ৮৮৯ জন। তাঁদের মধ্যে ঢাকায় ৭৮৯ এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ১০০ জন।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডটি শুরুতে ছিল ২২ শয্যার। রোগী বাড়তে থাকায় সেটি ৮০ শয্যার করা হয়। বর্তমানে এই ওয়ার্ডে ৯৯টি শয্যা থাকলেও গতকাল সেখানে রোগী ছিলেন ১২৭ জন। শয্যার পাশাপাশি মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এই হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন মাকসুদা বেগম (৫০)। বাড়ি পটুয়াখালীর সদর উপজেলার মৌকরন গ্রামে। তিনি গত মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হন। এই হাসপাতালে শুধু শয্যা নয়, স্যালাইনেরও সংকট রয়েছে। মাকসুদার বোন মাজেদা বেগম গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতাল থেকে তাঁদের তিনটি স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে দুটি স্যালাইন কিনতে হয়েছে।
ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে গতকাল গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের শয্যাসংকটের কারণে মেঝেতে রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিলেন ৯৪ জন। রোগীতে মেঝে ভরা থাকায় কোনো রোগীর জন্য মশারি টানানোর উপায় নেই।
ঢাকার আশপাশের জেলা ও উপজেলা থেকে রোগীরা বেশি আসছেন। ডেঙ্গুর যে চিকিৎসা, তাতে ১০০ রোগীর মধ্যে ২ জনের হয়তো ঢাকায় আনা লাগতে পারে। কিন্তু অনেকেই ভয়ে ঢাকায় চলে আসছেন।
এ বছর দেশে এত বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু আগে কখনো দেখা যায়নি। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগীকে ঢাকা শহরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য না আনার বা না পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে। তবে বাইরে থেকে ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা নিতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। কিছু জেলায় রয়েছে স্যালাইন–সংকটও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় (গত বুধবার সকাল আটটা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল আটটা) দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৮৭৫।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডেঙ্গু নিয়ে নতুন করে ২ হাজার ৮৮৯ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালগুলোয় ৭৮৯ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোয় ২ হাজার ১০০ জন ভর্তি হয়েছেন। এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৯৯ জন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৬ হাজার ৬২২ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোয় ১ লাখ ৩ হাজার ৭৭ জন ভর্তি হন।
রোগী সামলাতে হিমশিম
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিট ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা। গতকাল বৃহস্পতিবার দেখা যায়, প্রথমে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড খোলা হলেও এখন রোগীর এত চাপ যে তাতে আর সংকুলান হচ্ছে না। ফলে এখন সব রোগী একসঙ্গে রাখা হচ্ছে।
ভবনটির নিচতলার বারান্দায় হাঁটার পথে শয্যা পেয়েছেন হিজলার চরহিজলা গ্রামের জেলে মো. শাহিন (৩৫)। তিনি বলেন, তিন দিন হলো এখানে ভর্তি। চারটি স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। এর তিনটি কিনেছেন বাইরে থেকে এবং একটি হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সকালে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু ওয়ার্ডের প্রবেশপথ, হাসপাতালের বারান্দাসহ পুরো ভবনের নিচতলায় চারদিকে শয্যায়-মেঝেতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলছে। দুলাল সিকদার (৫৫) নামের এক রোগী জানান, তিন দিন ধরে এই হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বাইরে থেকে একটি স্যালাইন কিনেছেন।
পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন এস এম কবির হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে যে হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, এতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে স্যালাইন–সংকট দেখা দিতে পারে।
এবার ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগী অনেক বেশি। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার বাইরে এত ডেঙ্গু রোগী এবারই প্রথম দেখা গেল।
কিছু জেলায় স্যালাইনের সংকট
খুলনায় ডেঙ্গু চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। গতকাল এই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন ১৬৩ জন। এ ছাড়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতাল ও বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন ৫৮ জন।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাধারণ স্যালাইন মজুত রয়েছে ২ হাজার ১৪০ লিটার। প্রায় ১০ দিন স্যালাইন না থাকার পর গত বুধবার ৩ হাজার লিটার স্যালাইন পাওয়া গেছে। হাসপাতালের বাইরে বিভিন্ন ফার্মেসিতে সাধারণ স্যালাইন নেই। রোগীরা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেশি দাম দিয়ে স্যালাইন কিনছেন। কোম্পানিভেদে এক লিটার স্যালাইনের দাম ৬০ থেকে ৯০ টাকা। বাইরে থেকে রোগীদের স্যালাইন কিনতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।
দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এ টি এম নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মাঝে সাধারণ স্যালাইনের কিছুটা ঘাটতি ছিল। তবে বর্তমানে কোনো রোগীকে বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে না।
তবে সরকারি হাসপাতাল বাদে বাইরে ফার্মেসিতে এখনো স্যালাইনের সংকট রয়েছে। মুনতাহা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী মুক্তার হোসেন বলেন, কিছু দোকানে স্যালাইন আছে। কোম্পানি থেকে সরবরাহ বন্ধ। যাঁদের কাছে আছে, তাঁরা প্রতিটি স্যালাইন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত বেশি রাখছেন।
ঢাকায় আসছেন বাইরের রোগীরা
এবার ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগী অনেক বেশি। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার বাইরে এত ডেঙ্গু রোগী এবারই প্রথম দেখা গেল। ১৭ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু নিয়ে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবির। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিনি বাইরের ডেঙ্গু রোগী ঢাকা শহরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য না আনার বা না পাঠানোর অনুরোধ জানান।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মানা করলেও ঢাকার বাইরে থেকে ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা নিতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাঁদের অনেকেই ঢাকার বাইরে অন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আবার অনেকে ডেঙ্গু শনাক্ত হতেই ঢাকায় চলে এসেছেন। গতকাল রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, এসব হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাঁদের অনেকেই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন।
আহসান ইসলামের বয়স ছয় বছর। ছয় দিন ধরে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ভর্তি। ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর প্রথমে রায়হানকে কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানকার চিকিৎসকেরা তাকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন বলে জানালেন রায়হানের বাবা রহমতউল্লাহ।
মাদারীপুরের শিবচরে ফলের দোকান আমির হোসেনের। ছয় দিন আগে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পরে মাদারীপুরের দুই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে গত পরশু দিন তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
প্রতিদিনই ঢাকার বাইরে থেকে বেশ কয়েকজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন বলে জানান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার আশপাশের জেলা ও উপজেলা থেকে রোগীরা বেশি আসছেন। ডেঙ্গুর যে চিকিৎসা, তাতে ১০০ রোগীর মধ্যে ২ জনের হয়তো ঢাকায় আনা লাগতে পারে। কিন্তু অনেকেই ভয়ে ঢাকায় চলে আসছেন। তিনি বলেন, যেসব রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন, তাঁদের সবার পরিস্থিতি জটিলও থাকে না।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]