আবহাওয়া পরিস্থিতি
তীব্র দাবদাহে ভয়ংকর এপ্রিল
চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
গরমে মানুষের দুর্ভোগ। অসুস্থতার ঝুঁকি।
দেশজুড়ে বৃষ্টি হতে পারে ২৩ এপ্রিল থেকে।
দেশে দুই সপ্তাহ ধরে ভয়ংকর দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। এই দাবদাহ শুরু হয়েছে ২ এপ্রিল। চলতে পারে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, এপ্রিল মাসে সাধারণত কয়েকটি দাবদাহ বয়ে যায়। তবে এ ধরনের টানা দাবদাহ দেখা যায় না।
দাবদাহের প্রচণ্ড গরমে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। কোনো কোনো পরিবারে শিশুরা ঠান্ডা ও সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রবীণেরা গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সচ্ছলদের কেনা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বাইরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকারের জ্বালানি ব্যয়ও বাড়ছে। ১৩ এপ্রিল রেকর্ড ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে কেনাবেচার ক্ষতি করছে গরম। দিনমজুর ও শ্রমিকেরা বেশি গরমের কারণে বাড়তি কাজ করতে পারছেন না। সবচেয়ে উদ্বেগের দিক হলো, দাবদাহ ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করেছে। এখন মাঠে রয়েছে বোরো মৌসুমের ধান। এটিই দেশের চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মৌসুম। দাবদাহের কারণে ধানের চিটা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক সতর্কবার্তায় (১১ থেকে ১৭ এপ্রিলের জন্য) বলা হয়েছে, দেশে যে দাবদাহ চলছে, তাতে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের ধান ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে। ধানের পরিপক্ব পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা দানাগঠনকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে ফলন কমে যায়।
জানতে চাইলে ব্রির মহাপরিচালক শাহজাহান কবির প্রথম আলোকে বলেন, হাওর এলাকার বেশির ভাগ ধান পেকে গেছে। সেটার ক্ষতির আশঙ্কা কম। তবে উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকায় ধান পরে লাগানো হয়। সেখানে এই দাবদাহের সময়ে খুব সাবধানে ধানের পরিচর্যা করতে হবে। অবশ্যই জমিতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
গড় তাপমাত্রা কতটা বেশি
দেশে সাধারণত মার্চ মাসে গরম শুরু হয়। আর বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল। এ বছর মার্চে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। গরম ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এপ্রিলের দ্বিতীয় দিনে যশোর-চুয়াডাঙ্গা দিয়ে একটি দাবদাহ শুরু হয়। সেটি এখন দেশের দুই–তৃতীয়াংশ এলাকায় বিস্তৃত।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে থাকা বিগত ৬০ বছরের তাপমাত্রার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এপ্রিলে সারা দেশের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের একজন আবহাওয়াবিদ প্রথম আলোকে জানান, এ বছর এপ্রিলের প্রথম ১৬ দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
২ এপ্রিল থেকে দেশে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের টানা দাবদাহ সাধারণত দেখা যায় না।
এবারের এপ্রিলের দাবদাহের আরেকটি দিক হলো এর বিস্তৃতি বেশি। সাধারণত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি জেলায় এপ্রিল মাসে দুই থেকে তিনটি দাবদাহ বয়ে যায়। সেটাও তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি স্থায়ী হয় না। এবার এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে রংপুর বিভাগ ছাড়া সারা দেশেই মৃদু থেকে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে।
এপ্রিল মাসে সাধারণত দুই থেকে পাঁচটি কালবৈশাখী আঘাত হানে। সেই সঙ্গে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি হয়। মাসের শুরুতে আবহাওয়া অধিদপ্তর যে পূর্বাভাস দিয়েছিল, তাতে তিন থেকে পাঁচ দিন হালকা/মাঝারি এবং এক থেকে দুই দিন তীব্র কালবৈশাখীর আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত কালবৈশাখীর দেখা নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও বলেছিল, এ মাসে দুই থেকে তিনটি মৃদু/মাঝারি দাবদাহ বয়ে যেতে পারে এবং দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকতে পারে। দেখা যাচ্ছে, আবহাওয়ার আচরণ ভিন্ন। এমনকি যে গরম পড়ছে, তার ধরনও স্বাভাবিক নয়। কারণ, বাংলাদেশে গরমকালে বাতাসে আর্দ্রতা সাধারণত বেশি থাকে। এ বছর আর্দ্রতা খুবই কম দেখা যাচ্ছে। ফলে ঘাম হচ্ছে না, কিন্তু ঠোঁট ফাটছে, শরীর জ্বালাপোড়া করছে। বিগত দুই সপ্তাহ দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে, যা সাধারণত মরুভূমিতে দেখা যায়।
ঢাকায় গরম আরও বেড়েছে
রাজধানীর তাপমাত্রা গত শনিবার ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল, যা ছিল ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৬৫ সালে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। গতকাল রোববার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা আক্কু ওয়েদারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঢাকায় গতকাল গরম অনুভূত হয়েছে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাভূমি ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বেশি থাকলে সেখানে দাবদাহ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কারণ, দাবদাহে জলাভূমির পানি জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়। তা মেঘ তৈরি করে, বৃষ্টি নামায়। ফলে তাপমাত্রা কমে আসে। ঢাকার চারপাশের নদী, জলাভূমি, খাল ও সবুজ এলাকা কমছে। বিরূপ পরিস্থিতির এটাও কারণ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল–পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহুতল ভবন, কংক্রিটের রাস্তা ও এসি ঢাকাকে একটি তপ্ত ভূখণ্ডে পরিণত করেছে। শহরের জলাভূমি রক্ষা এবং গাছপালা বাড়ানোতে গুরুত্ব না দিলে সামনে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের আরও পড়তে হবে।’
আর্দ্রতা বাড়ছে, ঘাম বাড়বে
তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে দাবদাহকে মৃদু, ৩৮ থেকে ৪০ হলে মাঝারি ও ৪০ ডিগ্রির বেশি হলে তাকে তীব্র দাবদাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশে গতকাল তীব্র দাবদাহ বয়ে গেছে ঢাকা, খুলনা বিভাগের পুরো এলাকা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী ও পাবনার ঈশ্বরদীর ওপর দিয়ে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে গতকাল থেকে কিছু মেঘ ও জলীয় বাষ্প নিয়ে বাতাস বইতে শুরু করেছে। রাজধানী পর্যন্ত হালকা মেঘ এসেছে, আর্দ্রতা বেড়েছে। ফলে এখন গরমের সঙ্গে ঘামও হতে পারে। এই গরম ও ঘাম মানুষকে বেশি অসুস্থ করতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন আর্দ্রতা কম থাকায় মানুষ প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও ঘামত না। এখন আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় আগামী পাঁচ-ছয় দিন ভ্যাপসা গরম থাকতে পারে। তিনি বলেন, প্রচুর ঘাম হলে শরীর থেকে পানি বেরিয়ে গিয়ে অসুস্থতা বাড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রচুর পানি পান এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া ভালো।
স্বস্তির আশা ২৩ এপ্রিল থেকে
আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলেছে, আজ সোমবার দেশের বেশির ভাগ এলাকার তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে। তবে রাতে গরম কিছুটা বাড়তে পারে। পাঁচ দিনের পূর্বাভাসে বলা হয়, শেষের দিকে বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, দেশজুড়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে ২৩ এপ্রিল থেকে। তখন তাপমাত্রা কমে স্বস্তি নামবে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদা রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালে দাবদাহের ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মৃদু দাবদাহ কমে গিয়ে মাঝারি ও তীব্র দাবদাহ বাড়ছে। এবারের দাবদাহটি সেই অর্থে ব্যতিক্রম নয়। তিনি বলেন, এ ধরনের টানা দাবদাহ সামনের দিনগুলোয় আরও আসবে।