পাঠকের লেখা–৫৩
আমার চাকরির ইন্টারভিউ
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
ইন্টারভিউ কার্ড এসেছে। অনেক বড় এনজিও থেকে। সাত দিন পর পরীক্ষা। স্থান উত্তরা মডেল স্কুল।
উত্তেজনায় আমার ঘুম হারাম। উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। স্বপ্নের পরীক্ষা ভয়াবহ। লিখতে গেলেই কলমে কালি থাকছে না। মাঝেমধ্যে লজ্জার ব্যাপার ঘটছে। দেখি, খালি গায়ে পরীক্ষার হলে বসেছি। ছেলেমেয়ে সবাই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। এমন অবস্থায় ঘুম ভেঙে যায়। শরীর ঘামে ভিজে জবজবে। প্রচণ্ড পিপাসায় কলিজা ফাটার উপক্রম।
এ–জাতীয় যন্ত্রণা চলতেই লাগল। দুই দিন আগেই ঢাকায় চলে এলাম। উঠেছি বড় বোনের বাসায়। একজোড়া ভালো স্যান্ডেল কিনতে হবে। নতুন জুতা আমার জন্য মহাসমস্যা। পায়ে দিলে নির্ঘাত ফোসকা। আমি নতুন জুতা এড়িয়ে চলি। মাঝেমধ্যে উপায় থাকে না। পুরোনোগুলো ছিঁড়ে গেলে নতুন কিনতে হয়। কলেজে থাকতে বিকল্প ছিল। গুলিস্তান থেকে পুরোনো জুতা কিনে নিতাম। ফোসকা পড়ার ভয় থাকত না।
পোশাক-আশাকেও আমার সমস্যা। সবাই বলে আনস্মার্ট। কথা সত্য। আমার প্রিয় ঢিলেঢালা পোশাক। নতুন শার্ট গায়ে দিলে সবাই তাকিয়ে থাকে। বন্ধুরা কমেন্ট করে, খুবই বাজে কমেন্ট। আব্বার শার্ট গায়ে দিয়েছি কি না, জানতে চায়।
আমি নিরুপায়। বর্তমান হালফ্যাশনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারি না। সবার প্যান্ট যখন কোমরের নিচে, আমি তখন কোমরের দুই আঙুল ওপরে পরে উপস্থিত। সবাই আড়চোখে তাকায়।
জুতা নিয়ে টেনশনে পড়ে গেলাম। ইন্টারভিউয়ে স্যান্ডেল পরে যাওয়া রিস্কি। দেখা গেল, জুতার জন্যই চাকরি হলো না।
আমি শেষমেশ স্যান্ডেল পরেই হাজির হলাম।
১০টায় লিখিত পরীক্ষা, আমি ৮টায় গিয়ে উপস্থিত। এলাহি কারবার, শত শত তরুণ–তরুণী। সবার হাতেই ফাইলপত্র। কেউ আবার সাজেশন বই নিয়ে হাজির। অনেকের সঙ্গেই অভিভাবক আছেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মতো অবস্থা। বিশেষ করে নারী প্রার্থীদের। প্রায় সবাই তাঁদের মা-বাবাসহ উপস্থিত।
আমি ফাইল হাতে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আছি। টাই পরা দুই তরুণ একটা সাজেশন বই নিয়ে টানাটানি করছেন। তাঁরা খুবই উত্তেজিত, মনে হয় দুজনই প্রশ্ন খুঁজতে চাইছেন। টানাটানির এক পর্যায়ে সাজেশন ছিঁড়ে দুই ভাগ। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। দেখে মজা পাচ্ছি। বই ছেঁড়ায় দুজনই উত্তেজিত। একজন অন্যজনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছেন। একটা ছোটখাটো রেসলিং হতে পারে, হলে ভালোই হতো।
ঠিক এমন সময় ঘণ্টা বেজে উঠল। সবাই দৌড়ে স্কুলঘরের দিকে ছুটলাম।
খুবই সহজ প্রশ্ন, শুধু সহজ নয়, একেবারে পানিভাত। ১ ঘণ্টার পরীক্ষা ২০ মিনিটে শেষ। খাতা জমা দিয়ে মাঠে এসে দাঁড়িয়েছি।
এক ভদ্রলোক হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিলেন, বেলা দুইটায় স্কুল গেটের নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট দেওয়া হবে। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তিনটা থেকে ভাইভা।
আমি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে রিসেপশনে বসে উসখুস করছি। বেশভূষায় সবাই মোটামুটি স্মার্ট। শুধু আমার অবস্থাই খারাপ। ইন ছাড়া হাফ শার্ট, পায়ে বাটার স্যান্ডেল। আমি নিশ্চিত, বাদ পড়লে এই কাপড়চোপড়ের জন্যই পড়ব।
আমি আছি দোতলায়, ৩ নম্বর ভাইভা বোর্ডে। পাঁচজনের পরই ডাক পড়ল। পিয়নের প্রথম ডাক শুনতে পেলাম না, টেনশনে নিজের নাম ভুলে গেছি। দ্বিতীয় ডাকে লাফিয়ে উঠলাম। ভেতরে ঢুকে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তিনজন পরীক্ষকের দুজনই নারী, সবাই মোটামুটি বয়স্ক। একজন বসতে বলেই প্রশ্ন শুরু করলেন—
‘নাম কী?’
‘মনিরুল ইসলাম।’
‘আপনি কার চোখের মণি?’
নারী পরীক্ষকের প্রশ্নে কেমন একটা সুরেলা ছন্দ। আমি কিছুটা নিচু কণ্ঠে বললাম,
‘মায়ের চোখের।’
এবার পুরুষ পরীক্ষকের দরাজ কণ্ঠ,
‘বাবার চোখের নয়?’
‘বাবা নেই, স্যার; ছোট থাকতেই মারা গেছেন।’
পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। পরিবেশ পুরোপুরি আমার অনুকূলে। পিতৃহীন এই তরুণের করুণ কাহিনিতে তিন পরীক্ষকই ধপাস। কিসের ইংরেজি, কিসের বাংলা! আর কোনো প্রশ্নই হলো না। আমি আরও করুণ ভাব নিয়ে বসে রইলাম। পরীক্ষকের একজন আমাকে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললেন। আমি নিশ্চিত, যদি তিনজনকেও নির্বাচন করা হয়, তাহলে আমি ২ নম্বরে থাকব।
শেষমেশ চাকরিটা হয়েই গেল। দীর্ঘ ২৪ বছর পার হয়েছে, যেটা এখনো করেই যাচ্ছি।