সুন্দরবনে জলদস্যুর হাতে বারবার জিম্মি হওয়া অসীম পেশাই বদলে ফেললেন

একসময় মাছ ধরতেন অসীম মণ্ডল। তবে এখন পেশা বদলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানছবি: প্রথম আলো

বাবার সঙ্গে ১১ বছর বয়সে প্রথম মাছ ধরতে গিয়েছিলেন অসীম মণ্ডল। সুন্দরবনের হাওয়ায় বেড়ে ওঠা অসীম জানতেন, এটাই তাঁর আসল কাজ। বাবা প্রভাস মণ্ডল জেলে। তিনিও জেলে হবেন। হলেনও তা-ই। মাসের ২০-২২ দিন নৌকায় কাটিয়ে জোয়ার-ভাটা হিসাব করে মাছ ধরতেন।

পরে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট ভাই প্রসাদ মণ্ডলও যোগ দিলেন একই পেশায়। দিনরাত নৌকায় থাকার সময় নদীর পানিতে কোনো ঢেউ না তুলে নিঃশব্দে চলাচল করা কুমির তাঁকে ভীত করতে পারেনি কখনো। অসীমের ভাষায়, ‘আমরা সুন্দরবনের মানুষ কুমিরটুমির ভয় পাই না।’ অথচ মানুষের ভয়ে পেশা বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন তিনি ও তাঁর ভাই।

অসীম মণ্ডলের (৩৬) সঙ্গে দেখা হয় গত ২১ ডিসেম্বর খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের খেজুরিয়া গ্রামে। পাঁচ বছর ধরে তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। সুন্দরবনের দিকে মুখ করে গড়ে তোলা ইকো রিসোর্ট থেকে বুড়িরডাবুর বাজারসহ গ্রাম ঘুরে দেখতে ভাড়া করেছিলাম তাঁর ‘অটোভ্যান’। পরদিনও তাঁর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে ঘোরা হয়েছিল এদিক-ওদিক। এ সময়ের মধ্যে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। গ্রামে কে, কখন বাঘ দেখেছিল, কে বাঘের হামলার শিকার হয়েছিল, কুমির কার গরু-ছাগল টেনে নিয়ে গিয়েছিল, কে কতবার জলদস্যুর কবলে পড়েছিল—এসব খবর গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। জলদস্যুর হাতে জিম্মি হয়ে অসীম মণ্ডলের পেশা ছাড়ার গল্পটিও তাই জানা অনেকের।

অসীমের সংসারে আছেন স্ত্রী লিপিকা মণ্ডল ও একমাত্র সন্তান টোকন মণ্ডল (১২)। টোকন এবার সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে।

জলদস্যুর হাতে জিম্মি হওয়া

অসীমরা তিন বোন, দুই ভাই। অসীম বলেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে মাছ ধরতে ১০ দিনের জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি আর ছোট ভাই প্রসাদ। বাবা অসুস্থ থাকায় তিনি সঙ্গে যাননি। তাঁরা বাইরে থেকে টাকার বিনিময়ে একজন লোককে নেন।

অসীমের বক্তব্য, মাসে দুবার করে জলদস্যু তাঁকে ধরত। তখন ৫০০ টাকা করে দিতেন। সেবার (২০১৫ সাল) জলদস্যুরা এত নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল যে তাঁর মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কোনোরকমে জীবন নিয়ে বেঁচে আসতে পারলে সুন্দরবনে আর যাবেন না।

অসীম জানান, ১২টি নৌকা ছিল নদীতে। এগুলোতে তাঁদের প্রতিবেশী, স্বজনসহ মোট ৩৬ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিটি নৌকায় একজন করে এসেছিলেন টাকার বিনিময়ে কাজ করতে। অন্যরা জেলে। তাঁদের মহাজন ছিলেন ফারুক হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি। ভাটায় তাঁরা নদীর কিনার ঘেঁষে জাল পুঁতে আসতেন। জোয়ারে মাছ গিয়ে ঢুকত জালে। আবার ভাটায় পানি সরে গেলে মাছ আটকা পড়ত জালে। জোয়ার-ভাটার হিসাব করে মাছ ধরা হতো মধ্যরাতে। পরদিন সকালে মহাজন এসে মাছ দাম ধরে নিয়ে যেতেন। এভাবে মাছ বেচে কোনো দিন পাঁচ শ থেকে হাজার, কোনো দিন পাঁচ হাজার টাকাও পেতেন।

নিজেরা বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করতেন না কেন, জানতে চাইলে অসীম বলেন, নদী থেকে বাজারে যেতে ৯-১০ ঘণ্টা লাগত। বাজারে গিয়ে বিক্রি করার মতো সামর্থ্য ছিল না। মহাজনদের কাছে বিক্রি করাই ‘নিয়ম’। মহাজনেরা মাছ নিয়ে তিন গুণ বেশি দামে বাজারে বিক্রি করেন।

ওরা জিম্মি করেছিল ৩০ জনকে। একবার আমাদের এক দাদাকে বিস্কুট খেতে দিয়েছিল। দাদা বিস্কুট খেয়ে পানি চাইলে তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করে। একবার আরেক মহাজনের কম বয়সী এক জেলের মাথায় বন্দুক তাক করে। ওই ছেলেকে বলেছিল ৩ লাখ টাকা, ১০টা মোবাইল ফোন আর দুইটা সোনার চেইন এনে দিতে।
—অসীম মণ্ডল, পেশা বদল করা জেলে

আগের কথায় ফিরে গিয়ে অসীম মণ্ডল বললেন, সেবার নদীর বেশ গভীরে তাঁরা মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। বাড়ি ছাড়ার দুই দিন পরের ঘটনা। ভোর পর্যন্ত মাছ ধরেন। সকাল ১০টায় মহাজন এসে মাছ নিয়ে যান। বেলা ১১টার দিকে তাঁরা দেখেন, জলদস্যুদের ১০টি নৌকা তাঁদের দিকে আসছে। জলদস্যুরা কাছে এসে মহাজনের নাম জিজ্ঞেস করলেন। এরপর ১২টি নৌকা থেকে ৮ জনকে জিম্মি করে নিজেদের নৌকায় তুলে নিলেন। ওই আটজনের মধ্যে ছিলেন তিনি ও তাঁর ভাইও। টানা ছয় দিন জিম্মি ছিলেন বন্দুকধারী জলদস্যুদের হাতে। অন্যদের ছেড়ে দেওয়ার কারণ, তাঁরা যেন জিম্মি হওয়ার খবর এবং জলদস্যুদের দাবিদাওয়াগুলো সংশ্লিষ্টদের জানাতে পারেন।

নগদ অর্থ, মুঠোফোন, সোনার চেইনে মুক্তি

অসীম জানালেন, ওই সময় জলদস্যুর খুব উৎপাত ছিল। জিম্মি হওয়া জেলেরা যে মহাজনদের অধীন কাজ করতেন, ওই মহাজনেরাই মুক্তিপণ দিয়ে তাঁদের জিম্মিদশা থেকে ছাড়াতেন। পরে মাছ বা নগদ অর্থ দিয়ে মহাজনের দেওয়া সেই অর্থ ধাপে ধাপে পরিশোধ করতেন জেলেরা। বছরে একবার বড় অঙ্কের টাকা দিলে মহাজন ও জিম্মি জেলেদের নাম লিখে রাখতেন জলদস্যুরা। পরে বছরজুড়ে ওই জেলেদের নাম জিজ্ঞেস করে তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে ছোট ছোট অঙ্কের টাকা নিতেন তাঁরা।

অসীমের বক্তব্য, জলদস্যুদের কিছু বলার সাহস কারও ছিল না। জলদস্যুদের টাকা না দিয়ে কেউ মাছ ধরতে পারতেন না। তিনি এর আগেও জিম্মি হয়েছেন। এককালীন ২০-৩০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। মাসে দুবার করে জলদস্যুরা তাঁকে ধরতেন। তখন ৫০০ টাকা করে দিতেন। সেবার (২০১৫ সাল) জলদস্যুরা এত নিষ্ঠুর আচরণ, মারধর ও খিস্তিখেউড় করেন যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল মনে। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কোনোরকমে এবার জীবন নিয়ে বেঁচে আসতে পারলে আর যাবেন না সুন্দরবনে।

২০১৫ সালে মাছ ধরতে গিয়ে টানা ছয় দিন বন্দুকধারী জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ছিলেন অসীম
ছবি: প্রথম আলো

এর আগেও জিম্মি হয়েছিলেন, কিন্তু এবার জলদস্যুরা কী করেছিলেন যে এত ভয় ঢুকল, জবাবে অসীম বললেন, ‘ওরা জিম্মি করেছিল ৩০ জনকে। একবার আমাদের এক দাদাকে বিস্কুট খেতে দিয়েছিল। দাদা বিস্কুট খেয়ে পানি চাইলে তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করে। একবার আরেক মহাজনের কম বয়সী এক জেলের মাথায় বন্দুক তাক করে। ওই ছেলেকে বলেছিল, ৩ লাখ টাকা, ১০টা মোবাইল ফোন আর ২টা সোনার চেইন এনে দিতে। ওই ছেলে চুপ করে ছিল বলে মার দিয়েছিল। পরে ওই ছেলে বলল, “ভাই, আমাকে বরং মেরেই ফেলেন। এত টাকা কই পাব?”’ ছয় দিন পর তাঁরা ছাড়া পেলেও ওই ছেলে ছাড়া পায়নি। ছেলেটার ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা তাঁর জানা নেই।

কী পরিমাণ মুক্তিপণ দিতে হয়েছে জানতে চাইলে অসীম বললেন, ‘দুই লাখ টাকা, পাঁচটা ফোন আর একটা চেইন চেয়েছিল। এক লাখ টাকা দিতে চাইলে রাজি হয়নি। বলল, “তুমি যাও। তোমার ভাইকে রেখে দেব। বাকি টাকা এনে ভাইকে ছাড়ায় নিবা।” আমি বললাম, ভাইকে ছাড়া যাব না।’

শেষ পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা, পাঁচটা মুঠোফোন আর একটি সোনার চেইন দিয়ে তাঁরা আটজন ছাড়া পান বলে জানান অসীম। তিনি বলেন, এতে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছিল। এই টাকা ভাগ হয়েছিল ১২টি নৌকায় থাকা মানুষ ও মহাজনের মধ্যে। তাঁদের দুই ভাইকে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৩৫ হাজার টাকা। এর বাইরে সিগারেট, চাল, ডাল, পেঁয়াজসহ ৩০ হাজার টাকার বাজার জলদস্যুদের জন্য করে দিতে হয়েছিল মহাজনকে।

জিম্মি থাকার দিনগুলোতে এই জেলেদের খেতে দেওয়া হতো ভাত আর সুন্দরবনের মাছ দিয়ে রান্না তরকারি। এত ফোন, সোনার চেইন কেন নিতেন জলদস্যুরা জানতে চাইলে অসীম বলেন, ‘শুনেছি, পরিবারের সদস্যদের উপহার দেওয়ার জন্য নিত।’

আগের পেশায় আর ফিরতে চান না

অসীম জানান, মাছ ধরা ছাড়া কোনো কাজ জানতেন না। তাই জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার হওয়ার পর খুব কষ্টে পড়ে যান। এখন এলাকায় কৃষিকাজসহ অন্যান্য কাজের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তখন গ্রামে কোনো কাজ ছিল না। অনেক দূরে কম টাকায় অন্যের জমিতে কাজ করতে যেতেন। অনটনে দিন কেটেছে। এ অবস্থায় ২০১৯ সালে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কেনেন। ছোট ভাই আসবাব বানানোর কাজ শিখেছেন। ইকো রিসোর্টে কাজ করেন।

অসীম বলেন, ‘আমরা আর জেলে পেশায় ফিরব না। তবে সুন্দরবনের হাওয়া-বাতাসে মাছ ধরার নেশা সহজে কাটে না। মাঝে মাঝে নিজেদের জন্য মাছ ধরি নদীর কিনার থেকে।’