পানি নামতেই ভেসে উঠল বনের ক্ষত

বাঁধ কাটার আগে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬০ বসতঘর, কিছু ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট।

কৃত্রিম হ্রদের বাঁধ কেটে দেওয়ার পর পানি নেমে যাওয়ায় বনের ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট। হ্রদের দুই পাশে ডালপালাসহ মরা গাছ ও কাটা পাহাড়ের অংশ। গতকাল দুপুরে লোহাগাড়ার জঙ্গল বড়হাতিয়া ও সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া সীমান্তবর্তী এলাকায়ছবি: কাইছার হামিদ

চট্টগ্রামে বন ডুবিয়ে তৈরি করা প্রভাবশালীদের সে হ্রদ আর নেই। বাঁধ কেটে দেওয়ায় হ্রদের পানি নেমে গেছে। তবে পানি নামতেই স্পষ্ট হয়েছে বনের ক্ষতি। কৃত্রিম হ্রদে ডুবে থাকা সব গাছপালা মরে গেছে। সবুজ ঘন বন আর নেই। দীর্ঘদিন পানি জমে থাকায় একের পর এক পাহাড়ও ধসে পড়েছে।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া বনে এ দৃশ্য দেখা যায় গতকাল রোববার সকালে। তিন বছর আগে বড়হাতিয়া বনের প্রায় আড়াই হাজার একর বনভূমি ডুবিয়ে কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করেছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এর একটি অংশ সংরক্ষিত ও আরেকটি অংশ রক্ষিত। সেই হ্রদে মাছ চাষ করা হচ্ছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। হ্রদটি তৈরি করা হয়েছে বনের সোনাকানিয়া নামের একটি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে। বাঁধের দৈর্ঘ্য ২০০ ফুটের মতো। প্রস্থ ২০ ফুট ও উচ্চতা ১০০ ফুট।

গত শনিবার প্রথম আলোতে ‘বন ডুবিয়ে প্রভাবশালীদের হ্রদ’ শীর্ষক প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম এবং বাঁধের কারণে বন, পাহাড় ও কৃষিজমির ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়। বন বিভাগের দাবি, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়া শুরু করলেও সদ্য সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-১৫) আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভীর কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।

বাঁধ কেটে দেওয়ায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরেছে, এটা খুবই আশার কথা। আর যে অবস্থা তাতে কদম, জারুলসহ নানা ধরনের গাছ লাগানো যেতে পারে। বিলুপ্তপ্রায় ও বিপন্নপ্রায় বৈলাম, গর্জন, চাপালিশসহ স্থানীয় পরিবেশ উপযোগী গাছের চারা রোপণ করা দরকার।
মো. কামাল হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক

এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর শনিবার বিকেলেই বাঁধ কাটার কাজ শুরু করে বন বিভাগ। সন্ধ্যায় বাঁধের মাঝবরাবর কেটে দিলে পানিপ্রবাহ শুরু হয়। আর রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে বাঁধটি পুরোপুরি অপসারণ করা হয়। এরপর মধ্যরাতেই কৃত্রিম হ্রদের পানি নেমে যায়। তা ছড়া-খাল ও লোকালয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে।

গতকাল সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, কৃত্রিম হ্রদের ভেতরে এখনো কিছু কিছু অংশে পানি জমে রয়েছে। স্থানীয় লোকজন এই পানিতে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন। তবে যেখান থেকে পানি নেমে গেছে, সেখানে বন ধ্বংসের চিত্র উঠে এসেছে। পানিতে ডুবে থাকা গাছগুলোর মধ্যে প্রাণ নেই। মরা গাছগুলো মৃত ডালপালা নিয়ে কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছে। হ্রদের কারণে পানি জমে থাকায় পাহাড়গুলোর মাটি ধসে পড়েছে। চোখে পড়ল হ্রদের বিস্তৃতি বাড়ানোর জন্য পাহাড় কাটার দৃশ্যও।

এদিকে গতকালও বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বন বিভাগ বলছে, হ্রদ তৈরির কারণে গামারি, সেগুন, চিকরাশি, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় প্রায় পাঁচ লাখ গাছ মারা গেছে। ডুবে যাওয়া জায়গার মধ্যে বন্য হাতির চলাচলের পথ ছিল। নানা প্রজাতির প্রাণী বাস করত সেখানে।

বাঁধ কেটে দেওয়ায় হ্রদের পানি নেমে গেছে। এখন সেখানে আবার বনায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে বন বিভাগের। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চলতি অর্থবছরে বাজেটের স্বল্পতা রয়েছে। তবে আগামী অর্থবছরে হ্রদ এলাকায় বনায়ন করা হবে। আবার যাতে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল গড়ে ওঠে এবং হাতি চলাচলের পথ সচল হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

কৃষকদের মতে, বাঁধ দেওয়ার ফলে ছড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতে লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার ৪ হাজার ২৫৫ একর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কৃষকেরা শুরু থেকেই সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করলেও প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি।

এখন বাঁধ না থাকায় পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তাই চাষবাস নিয়ে দুশ্চিন্তা কমেছে কৃষকদের। লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া এলাকার কৃষক দেলোয়ার হোসেন প্রথমে আলোকে বলেন, ‘বাঁধ ভেঙে দেওয়ায় লোহাগাড়ার কৃষকেরা খুশি। আমরা এখন নতুন করে চাষাবাদ করতে পারব। সোনাকানিয়া অংশে কৃষকেরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাঁরা স্থায়ীভাবে লাভবান হবেন। ওই এলাকায় পানির অভাবে দীর্ঘদিন চাষাবাদ হতো না। এখন চাষাবাদ শুরু হবে। যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ দিলে ভালো হয়।’

বাঁধ কেটে দেওয়ায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরেছে, এটা খুবই আশার কথা। আর যে অবস্থা তাতে কদম, জারুলসহ নানা ধরনের গাছ লাগানো যেতে পারে। বিলুপ্তপ্রায় ও বিপন্নপ্রায় বৈলাম, গর্জন, চাপালিশসহ স্থানীয় পরিবেশ উপযোগী গাছের চারা রোপণ করা দরকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মো. কামাল হোসেন

৬০টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত

বাঁধ কেটে দেওয়ায় হ্রদের পানিতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ও সাতকানিয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী সোনাকানিয়া এলাকায় ৬০টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত আর প্রায় ৮০০ একর বোরো ও সবজিখেত তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া ভেঙে গেছে সোনাইছড়ী খালে নির্মিত স্লুইসগেটটিও।

সাতকানিয়ার কালামিয়ার পাড়ার কৃষক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, তিনি চার একর বোরো ও আধা একর জমিতে আলুর চাষ করেছিলেন। বাঁধের ছেড়ে দেওয়া পানিতে সব শেষ হয়ে গেছে। আগে থেকে না জানিয়ে হ্রদের পানি ছেড়ে দেওয়ায় এমন ক্ষতি হয়েছে।

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস বলেন, আপাতত তিন টন চাল ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য কম্বল বরাদ্দ করা হয়েছে। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য আরও বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এদিকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বন পুনরুদ্ধারে অতি দ্রুত বনায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বন–গবেষকেরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধ কেটে দেওয়ায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরেছে, এটা খুবই আশার কথা। আর যে অবস্থা তাতে কদম, জারুলসহ নানা ধরনের গাছ লাগানো যেতে পারে। বিলুপ্তপ্রায় ও বিপন্নপ্রায় বৈলাম, গর্জন, চাপালিশসহ স্থানীয় পরিবেশ উপযোগী গাছের চারা রোপণ করা দরকার। আর বাঁশের চারা রোপণ করা দরকার। বাঁশ যেমন মাটি ধরে রাখবে, তেমনি হাতির খাবারের জোগান দেবে। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে অবক্ষয়প্রাপ্ত বন আবার ফিরে আসবে। একই সঙ্গে হাতি ও বন্য প্রাণী, জীবজন্তুর আবাস গড়ে উঠবে।