ইন্টারনেট সেবা: নজরদারির প্রশ্নে আটকে আছে স্টারলিংক নিয়ে সিদ্ধান্ত
মাস তিনেক আগে বাংলাদেশে টেলিকম ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে যায় বৈশ্বিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক। তাদের প্রযুক্তি এনে পরীক্ষা–নিরীক্ষাও করা হয়েছে। তাতে সফলভাবে উতরে গেছে স্টারলিংক। তবে বাংলাদেশ সরকারের বিধিসম্মত নজরদারির যে নীতি আছে, সে প্রশ্নে স্টারলিংককে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত আটকে আছে।
বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা স্পেসএক্সের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান স্টারলিংক। প্রচলিত ইন্টারনেট সেবা মুঠোফোন টাওয়ার ও সাবমেরিন কেব্লনির্ভর হলেও স্টারলিংক কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়। এ কারণে পৃথিবীর দুর্গম অঞ্চলেও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বিশ্বের প্রায় ৫০টির বেশি দেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম রয়েছে।
গত ২৬ ও ২৭ জুলাই স্টারলিংকের প্রতিনিধি জোয়েল মেরিডিথ ও পার্নিল উর্ধারশির সঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশে স্টারলিংকের ব্যবসা, প্রযুক্তিগত কার্যকারিতা ও বাংলাদেশের আইনের বিষয়ে আলোচনা হয়।
দুই বছর ধরে স্টারলিংক বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে। তারা দুবার বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। বিডা বিষয়টি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) জানায়। তবে শুরুর দিকে স্টারলিংকের প্রতি বিটিআরসির অনাগ্রহ ছিল। চলতি বছর বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড স্টারলিংকের প্রযুক্তি পরীক্ষার জন্য বিটিআরসির অনুমোদন নেয়। পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে স্টারলিংকের কিছু প্রযুক্তিও গত জুলাই মাসে বাংলাদেশে আসে।
বাংলাদেশের জন্য স্টারলিংকের প্রযুক্তিগত কার্যকারিতা নিয়ে সন্তুষ্টি থাকলেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতে সরকারের বিধিসম্মত প্রবেশাধিকারের (ল’ফুল ইন্টারসেপশন) বা নজরদারির সুযোগ। গত জুলাইয়ের বৈঠকেই এ শর্তের কথা স্টারলিংককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
স্যাটেলাইট কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলে টেলিযোগাযোগব্যবস্থা ব্যাহত হলে কোম্পানির প্রযুক্তি দিয়ে সেবা দেওয়া যায়। কিন্তু স্যাটেলাইট কোম্পানির এই প্রযুক্তি গাজীপুরে রাখা। এটা দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় নেওয়া এবং সেখানে স্থাপন (সেটআপ) করা পর্যন্ত পুরো বিষয়টি সময় সাপেক্ষ। তবে স্টারলিংকের প্রযুক্তি যেকোনো স্থানেই রাখা যায় এবং এর সেটআপে তেমন সময় লাগে না। ফলে কোনো এলাকায় দুর্যোগের কারণে টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যাহত হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্টারলিংকের প্রযুক্তির মাধ্যমে সেবা দেওয়া সম্ভব।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহ্জাহান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রযুক্তিগত পরীক্ষা–নিরীক্ষা হয়েছে। এটা খুবই সহায়ক। তবে স্টারলিংকের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বাংলাদেশের জন্য স্টারলিংকের প্রযুক্তিগত কার্যকারিতা নিয়ে সন্তুষ্টি থাকলেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতে সরকারের বিধিসম্মত প্রবেশাধিকারের (ল’ফুল ইন্টারসেপশন) বা নজরদারির সুযোগ। গত জুলাইয়ের বৈঠকেই এ শর্তের কথা স্টারলিংককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দেশের আইনে টেলিযোগাযোগ খাতে সরকারের যেসব অনুমোদিত সংস্থা আছে, তারা বিধিসম্মত প্রবেশাধিকার বা নজরদারির সুযোগ পায়। জনগণের কাছে কী যাচ্ছে, কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হচ্ছে কি না, এসব যেন সরকার নজরে রাখতে পারে। এসব শর্তের কথা স্টারলিংককে বলা হয়েছিল।
বাংলাদেশে ব্যবসা করার কিছু নীতি আছে। স্টারলিংককে বিডার কাছে আবেদন করতে হবে, স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইডথের জন্যও অনুমতির ব্যাপার আছে।মোস্তাফা জব্বার, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী
স্টারলিংক প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, সব ধরনের ব্যান্ডউইডথে বিটিআরসির নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা আছে। স্টারলিংক বিধিসম্মত নজরদারির সুযোগ কীভাবে দেবে, সেটা এখনো জানায়নি। তাদের সংযোগ থেকে পর্ন, জুয়ার সাইট বন্ধের সুযোগ দিতে হবে।
মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করার কিছু নীতি আছে। স্টারলিংককে বিডার কাছে আবেদন করতে হবে, স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইডথের জন্যও অনুমতির ব্যাপার আছে।
স্টারলিংকের সংযোগ মূলত ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে এ সেবা রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে স্টারলিংকের কার্যক্রম রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদের অপেক্ষায় আছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানে ২০২৪ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত জুলাইয়ের বৈঠক নিয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বলেছিলেন, দুর্গম অঞ্চলে ও দুর্যোগকবলিত জনগোষ্ঠীকে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে স্টারলিংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। দ্রুতই পাইলট কার্যক্রম শুরুর আশা করেছিলেন তিনি।
জানতে চাইলে আইসিটি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, স্টারলিংকের বিষয়টি আর এগোয়নি।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবস্থায় অনেক ক্ষমতাধর হয়ে উঠছে ইলন মাস্কের স্টারলিংক। স্যাটেলাইট ইন্টারনেটে মাস্কের এই সক্ষমতা বিশ্ব কোনো নেতার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমস এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, চীন ইলন মাস্কের কাছে আশ্বাস চেয়েছে যে তিনি সে দেশে স্টারলিংক চালু করবেন না। চীনে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সর করা হয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের ফ্রিডম ‘অন দ্য নেট ২০২৩’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতা কমেছে। বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৪১। অর্থাৎ ইন্টারনেটে বাংলাদেশের নাগরিকরা আংশিক স্বাধীন।
বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মাস্ক বরাবরই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে এসেছেন। যদিও বাক্স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তাঁর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গত বছরের ২৭ এপ্রিল মাস্ক এক টুইটে বলেছিলেন, বাক্স্বাধীনতা বলতে যা আইনের সঙ্গে যায়, সেটাকেই তিনি বোঝেন। আইনের বাইরে যায় এমন সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে তিনি।
চলতি বছরের মে মাসে আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইলন মাস্কের টুইটারের মালিকানা পাওয়ার পর গত বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত আধেয় (কনটেন্ট) সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধে টুইটার (এক্স) ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সাড়া দিয়েছে। এর মধ্যে তুরস্ক ও ভারতের শত শত অনুরোধ রয়েছে। এতে করে তাঁর (মাস্ক) বাক্স্বাধীনতার অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য এটি বড় এক বাজার। এখানে ব্যবসা করতে হলে সরকারের নীতি মেনেই আসতে হবে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় ইন্টারনেট ডাউন, বিরোধীদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে দ্রুত গতির ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা আছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের ফ্রিডম ‘অন দ্য নেট ২০২৩’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট স্বাধীনতা কমেছে। বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৪১। অর্থাৎ ইন্টারনেটে বাংলাদেশের নাগরিকরা আংশিক স্বাধীন।