ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের দপ্তর এখনই হচ্ছে না। দপ্তর খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। তাই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের আসন্ন ঢাকা সফরে এ বিষয়ে কোনো চুক্তি সই হচ্ছে না।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র গত রোববার প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। ঢাকায় দপ্তর খোলার বিষয়ে মানবাধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে গত মাসে প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এদিকে দুই দিনের সফরে আজ রাতে ফলকার টুর্কের ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। এই সফরে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, আইন ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে ফলকার টুর্কের। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি।
মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাব
বাংলাদেশে ৫ আগস্ট পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গত মাসে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের দপ্তর খোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। দপ্তর চালুর বিষয়ে ফলকার টুর্কের সফরেই একটি চুক্তি সই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে একটি খসড়াও দেয় জাতিসংঘ।
ওই খসড়ায় বলা হয়, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের এদেশীয় দপ্তর চালু হলে সেটি মানবাধিকার সমুন্নত ও বিকাশের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক যেসব সনদ অনুসমর্থন করেছে, তার সঙ্গে সংগতি রেখে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে দপ্তর থেকে পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হবে।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত দপ্তর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সমুন্নত রাখতে বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। আন্তসীমান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সুরাহা ও বলপূর্বক গুমবিষয়ক কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নানা সহায়তা দেবে। এই দপ্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে যুক্ত করার ওপর জোর দেবে। পুলিশ এবং আইন সংস্কারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও কারিগরি সহায়তাসহ সংস্কার প্রক্রিয়ায় কারিগরি সহায়তা দেবে।
মৌলিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে অঙ্গীকার করার বিষয়ে বাংলাদেশের সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।এম. সুফিউর রহমান, জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি
খসড়ায় জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের অবাধে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কোনো গ্রেপ্তার, আটক এবং জেরা করার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের দপ্তরের প্রতিনিধিদের অবাধে প্রবেশাধিকার দিতে হবে।
প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার পক্ষে যুক্তি
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের প্রস্তাবে হুটহাট করে সাড়া দেওয়াটা সমীচীন হবে না বলে মনে করছে সরকার।
কর্মকর্তাদের মতে, জুলাই-আগস্টে নৃশংসতা ঘটেছে স্বৈরশাসনের নিষ্পেষণে। মানবতাবিরোধী অপরাধও ঘটেছে। কিন্তু জাতিগত কোনো সংঘাত হয়নি যে এখনই মানবাধিকার পরিষদের দপ্তর খোলার অনুমতি দেওয়ার মতো যৌক্তিক কোনো কারণ আছে। বরং এই মুহূর্তে রাজনৈতিক সংবেদনশীল এক পরিবেশে তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাতে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নটি সামনে আসতে পারে। জাতিসংঘের বিষয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। ফলে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির এমন আশঙ্কাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখাটা সমীচীন বলে মত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
ঢাকা, নিউইয়র্ক ও জেনেভার একাধিক কূটনৈতিক সূত্র এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর সব সময় দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত হয়। দাতা সংস্থাগুলো সাধারণত এই দপ্তরকে সেই দেশটির অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়নে প্রভাব সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে সেই দেশের কোনো নীতি যখন দাতাদেশগুলোর বিপক্ষে যায়, তখন তারা মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ওই দপ্তরের মাধ্যমে।
১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, গায়ানা, মেক্সিকো, নাইজার, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৯ টি দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের দপ্তর রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক দুই কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের দপ্তর কাজ করে। ধরা যাক, এই অভিযোগে বাংলাদেশ তখন দপ্তরের কোনো জাতিসংঘের কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করল। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক ধরনের তিক্ত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা ব্যাপক অর্থে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
জেনেভায় বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ ফেলো এম. সুফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ এখন প্রতিনিয়ত এক ধরনের যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের মধ্যে সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রয়েছে। এর পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরের বিবর্তন কেমন হবে, সেটাও জানা নেই। তাই সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চিত্র স্পষ্ট হওয়া এবং পরিবর্তিত সামাজিক রাজনৈতিক পরিমন্ডলে অংশীজনদের ভূমিকা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত মৌলিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে অঙ্গীকার করার বিষয়ে বাংলাদেশের সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের মধ্য দিয়ে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, গায়ানা, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৯ টি দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের দপ্তর রয়েছে।