কবিতা
রেস্ট
মোফাজ্জল করিম
রাত্রিসোনা, তুমি বারবার আমাকে ঘুমাতে বলো,
বলো, এই যে জন্মবোকা ব্যস্ত মানুষ,
বালিশে মাথা রেখে চৈতন্যের বাঁধন খুলে
এলিয়ে দিয়ে গা,
সবকিছু সরিয়ে রেখে
ছড়িয়ে দিয়ে হাত এবং পা
পারো না একটুখানি রেস্ট নিতে,
রেস্ট নিতে পারো না?
এটা তুমি ঠিকই বলেছ রাত্রি,
রেস্ট তো নেওয়াই উচিত। সারা দিন দৌড়ে ফিরে
রেসের ঘোড়ার মতো এখন তো রেস্ট নেওয়াই উচিত।
আর রেস্টের জন্য সবাই জানে কোন সময়টা বেস্ট। অবশ্যই রাত্রি।
তবে কিনা এই অনন্ত পথের যাত্রী
সবাইকে বলে বেড়ায়: রাত্রি হতে পারে বেস্ট,
তবে তোমরা সকলে জেনে রেখো, আমার এখনো অনেক
অনে–ক কাজ বাকি, কবি রবার্ট ফ্রস্টের সেই প্রায়োচ্চারিত চরণটির মতো:
‘অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।’
আর এ–ও বলি: তার আগে খামাখা আমাকে বিরক্ত করো না তো কেউ।
আই শ্যাল টেক রেস্ট অনলি হোয়েন আই উইল বি লেইড টু রেস্ট।
রাত্রিসোনা, বরং তুমি ঘুমাও এখন
তোমাকে তো চলে যেতে হবে সেই সাতসকালেই, সূর্য ওঠার আগেই।
আর আমি ঘুমালে আর জাগব না।
ঘরের দরজায় ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব’ সাইন লাগিয়ে আমি
ঘুম দেব—আদিহীন অন্তহীন
নিশ্ছিদ্র নিদ্রা।
দেশ, যে শব্দে বেঁধে ফেলা যায় তোমার শিরদাঁড়া, তোমার ভাষা, তোমার নীরবতাও
শাহীন মমতাজ
কারা যেন শিস দেয় অন্ধকারে,
মধ্যরাতে, গোপন গলিতে।
তোমার মস্তিষ্কে, কোষে বহুদিন আগের কবিতা
পোড়ে,
নীরক্ত ধমনিপথে
বাতাসে সে পুড়ে যাওয়া কবিতার ছাই
ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গিয়ে শ্বাস বন্ধ করে দেয়,
মৃত্যু ডেকে আনে।
মাটির গভীর নিচে শুয়ে থাকা নামগুলো ডিসেম্বর এলে মনে পড়ে।
নদীর অচেনা গতিপথ বেয়ে ভেসে যায়
সমস্ত নিমেষ। মনে হয়
তোমার পতাকা, দৃষ্টি, সমূহ সকালবেলা হয়তোবা,
একদিন দেশ খুঁজে পাবে।
অন্য দেশের ধারণা
রওশন আরা মুক্তা
না, অন্য দেশের পতাকা পায়ে মাড়ানো ঠিক না। তবে সীমান্তে গুলি করে অন্য দেশের মানুষ মারা ঠিক; অন্য দেশের সব নদীমুখে ড্যাম বসানো ঠিক। নদী শুকিয়ে মরে গেলে মরে যাক, অন্য দেশে বন্যা হোক, সব ভেসে যাক—অন্য দেশে গুপ্তচর পাঠাও, অন্য দেশে ড্রোন ওড়াও, অন্য দেশে ‘সাহায্য’ দাও, অন্য দেশে বাহিনী ঢোকাও; অন্য দেশের সাথে বসে ঠিক করো—অন্য দেশ থেকে করবে কত মুনাফা! তারপর অন্য দেশের সাথে ব্যবসা করো, তারপর অন্য দেশকে সহজ শর্তে ঋণ দাও, অন্য দেশকে বলো: ঠিকঠাক চলবা; যেখানে যেমন বলার সেইমতো বলবা। খাওয়ালে খাওয়াব, নইলে অভুক্ত থাকবা। অন্য দেশে তো বাস করে অন্য দেশের লোকেরাই! অন্য দেশের রক্তখেকোরা অন্য দেশের মানুষদের কেয়ার করে থোড়াই।
লাশেদের দলে
নাহিদ ধ্রুব
চোখ খোয়া গেছে কারও কারও
কারও কারও বেঁকে গেছে মুখ—
সুদিন দেখার অজুহাতে,
মরে নাই তাদের অসুখ...
আরও কত শব চারপাশে
বেনামি হাওয়ার মতো আসে,
কী ছিল তাদের পরিচয়—
নাম নেই কোনো ইতিহাসে!
দেয়ালে দেয়ালে রয়ে গেছে
দগদগে বুলেটের ছাপ—
ইতিহাসে সব লেখা হবে,
ইতিহাসে লেখা হবে পাপ...
জগৎ হয়তো ফিরে পাবে,
হারানো ছন্দের মাঝে গতি
সফল বিপ্লব শেষে ভাবি—
কার হলো কতটুকু ক্ষতি!
স্বজনের আহাজারি শুনে,
ভার হয়ে আসে ফের বুক—
সুদিন দেখার অজুহাতে,
মরে নাই তাদের অসুখ...
মরে নাই তাদের অসুখ,
মরবে না আর কোনো ছলে—
নিরাময় নেই তবু জানি,
আমি আছি লাশেদের দলে।