‘ছাদের সিঁড়িতে একা পড়ে ছিল শিশুটি, মা আটকে ছিলেন বন্যার পানিতে’

সম্প্রতি ফেনীতে বন্যাকবলিত একটি ভবনের সিঁড়ি থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে মায়ের কাছে পৌঁছে দেন স্বেচ্ছাসেবীরাছবি: মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে সংগৃহীত

চারপাশে থই থই পানি। কোথাও কোমরসমান, কোথাও গলাসমান, আবার কোথাও একতলার ওপরে উঠে গেছে পানি। এমন পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী মানুষ। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই, দোকানপাটও বন্ধ। ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় নেই। সম্প্রতি এমন অবস্থার মধ্যেই বন্যাদুর্গত এলাকায় প্রশাসনের পাশাপাশি উদ্ধারকাজ চালিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এই স্বেচ্ছাসেবীদের কেউ কোনো সংগঠনের হয়ে কাজ করেন, কেউ শিক্ষার্থী, কেউবা নিতান্তই সাধারণ মানুষ। কোনো অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অন্যের বিপদে। তেমনই একজন স্বেচ্ছাসেবী মোস্তাফিজুর রহমান।

গত ২১ আগস্ট মোস্তাফিজুর ও তাঁর সঙ্গীরা যখন বন্যাদুর্গত ফেনী সদরে পৌঁছান, তখন মিজান রোডেই ছিল কোমরপানি। ভেতরের দিকের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। অনেক জায়গায় বাড়িগুলো একতলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। সে রাতেই একটি নৌকা নিয়ে উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন তাঁরা। শিশু, বৃদ্ধ, প্রসবব্যথায় ছটফট করা নারীসহ বিপদে পড়া বন্যার্তদের তাঁরা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের।

ফেনী শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার ভেতরে আলোকদিয়া এলাকায় ঢোকার রাস্তায় ১০ ফুট পর্যন্ত পানি ছিল। সেখান দিয়ে নৌকা নিয়ে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড স্রোতের মধ্যে তাঁরা অন্তত তিনজন মানুষের মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখেছেন। কয়েকটি জীবিত গরু-ছাগলও ভেসে যেতে দেখেন তাঁরা।

২২ আগস্ট ভোররাত চারটার দিকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফিজুর তাঁর এক সঙ্গীকে নিয়ে পানিবন্দীদের উদ্ধার করছিলেন। ভরসা ছিল একটি ডিঙি। স্রোত এত বেশি ছিল যে নৌকা চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অলিগলির ভবনে আটকে পড়া মানুষজন উদ্ধারের আকুতি জানাচ্ছিলেন। কেউ বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার করছিলেন।

মোস্তাফিজুর বলেন, হঠাৎই তাঁরা একটি ভবনের দোতলার বারান্দা থেকে একজন নারীর চিৎকার শুনতে পান। প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন সেই নারী। তাঁরা তখন নৌকা নিয়ে বাড়ির গেটের কাছে যান। ওই নারীকে দোতলা থেকে নামিয়ে আনা হয়। কোনোরকমে নৌকায় তোলা হয় তাঁকে। তিনিও তখন বন্যার পানিতে ভিজে যান। ওই অবস্থাতেই তাঁকে নৌকায় শুইয়ে দেওয়া হয়। নৌকায় আর জায়গা নেই। স্বেচ্ছাসেবীরা তখন গলাসমান পানিতে নেমে পড়েন। শহরের শৌচাগারের আবর্জনায় ভরা সেই পানি। তার মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবীরা সাঁতরে নৌকা টেনে টেনে ওই নারীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেন।

‘এমনও সময় গিয়েছে যে রাত-দিন পানিতে ভিজেছি, ঘুম নেই, ২৪ ঘণ্টায় হয়তো একবারের জন্যও বসার সুযোগ হয়নি। তবে এমন পরিস্থিতিতে কাজ করতে আমাদের একবারের জন্যও খারাপ লাগেনি। শুধু মনে হয়েছে, মানুষকে উদ্ধার করছি।’
মোস্তাফিজুর রহমান, সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা

২২ আগস্টেই আরেক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন মোস্তাফিজুর ও তাঁর সঙ্গীরা। সকাল সাতটার দিকে তাঁরা নৌকা নিয়ে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছিলেন। ছয়তলা একটি ভবনের পঞ্চম তলা থেকে এক ব্যক্তি মোস্তাফিজদের ডেকে বলেন, তাঁর পাশের একতলা ভবনের সিঁড়ির ওপর একটি শিশু একা পড়ে আছে। সাত-আট মাস বয়সী শিশুটির বাবা বাড়িতে ছিলেন না। মা শিশুটিকে সেখানে শুইয়ে রেখে বাইরে থেকে কিছু আনতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সাঁতার জানেন না। পানি বেশি হওয়ায় ফিরতে পারছিলেন না। তিনি পাশের একটি ভবনে আটকা পড়েন।

স্বেচ্ছাসেবীরা তখন সেখানে যান। সিঁড়িতে ছাদের কাছেই শিশুটি শুয়ে ছিল। শিশুটি কাঁদছিল না। চুপচাপ শুয়ে ছিল। তাঁরা তাকে মাথার ওপর তুলে নিয়ে আসেন। নৌকায় তোলেন। এরপর স্বেচ্ছাসেবীরা শিশুটির মাকেও খুঁজে বের করেন। শিশুটির মা তখন অনুরোধ করেন, তাঁদের যেন শহরের প্রধান সড়কে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখানে গেলে তিনি তাঁর স্বামীর সন্ধান পাবেন। পরে তাঁদের সেখানে পৌঁছে দেওয়া হয়।

মোস্তাফিজুর বলেন, ‘একটানা ১২ ঘণ্টা উদ্ধারকাজ চালিয়ে আমরা যখন অনেক ক্লান্ত, তখনই শিশুটিকে আমরা উদ্ধার করি। তাকে উদ্ধার করতেই আমাদের মনে হচ্ছিল, সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে বেশ শক্তি ফিরে পেয়েছিলাম। শিশুটি কান্না করছিল না, কিন্তু আমরা না গেলে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে পানিতে ভেসে যেত।’

বন্যা শুরু হওয়ার পর বোনের পরিবারের খোঁজ পাচ্ছিলেন না এক তরুণ। বোন বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে, তা–ও জানতে পারেননি তিনি। ওই তরুণকে নৌকায় তুলে স্বেচ্ছাসেবীরা তখন তাঁর বোনের বাড়ি খুঁজতে থাকেন। বাড়ির সামনে পৌঁছানোর পর দেখা যায়, একতলা ভবনের ছাদ পর্যন্ত ডুবে গেছে। ভবনের ছাদে থাকা পানির ট্যাংকের ওপরে চার বছরের শিশুসন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে বসে আছেন ওই তরুণের বোন। তিনজনকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু নৌকাটি ছোট হওয়ায় একসঙ্গে সবাইকে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। দুইবারে তাঁদের উদ্ধার করে শহরের প্রধান সড়কে পৌঁছে দেওয়া হয়।

দুজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে নৌকায় তোলার পর নৌকায় আর বসার জায়গা ছিল না। স্বেচ্ছাসেবীরা তখন গলাপানিতে নেমে টেনে টেনে নৌকা নিয়ে যান
ছবি: মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে সংগৃহীত

শহরের একটি গলিতে একজন বৃদ্ধ লোক মোস্তাফিজুরদের নৌকা দেখে ডাকছিলেন, ‘বাবা আমাকে বাঁচাও, অনুরোধ করি।’ মোস্তাফিজুররা তখন কাছে গিয়ে দেখেন, পানি ঠেলে ওই ব্যক্তি সামনে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রচণ্ড স্রোতের কারণে এগোতে পারছেন না। বৃদ্ধ তখন স্বেচ্ছাসেবীদের বলেন, ‘আমার পরিবার এখানে একটি তিনতলা ভবনে থাকে, আমি ঢাকা থেকে এসেছি, ওদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। পানির কারণে এখন আর সামনে যেতে পারছি না।’ ওই ব্যক্তি বারবার বলছিলেন, ‘মরলে পরিবারসহ একসঙ্গে মরব, শুধু আমায় বাসায় দিয়ে আসো।’

ওই ব্যক্তিকে মোস্তাফিজুররা তখন নৌকায় তুলে নেন। প্রচণ্ড স্রোতের বিপরীতে নৌকা নিয়ে তাঁকে বাসায় পৌঁছে দেন তাঁরা।

মোস্তাফিজুর বলেন, ফেনী শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার ভেতরে আলোকদিয়া এলাকায় ঢোকার রাস্তায় ১০ ফুট পর্যন্ত পানি ছিল। সেখান দিয়ে নৌকা নিয়ে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড স্রোতের মধ্যে তাঁরা অন্তত তিনজন মানুষের মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখেছেন। কয়েকটি জীবিত গরু-ছাগলও ভেসে যেতে দেখেন তাঁরা।

মোস্তাফিজুর বলেন, ‘এমনও সময় গিয়েছে যে রাত-দিন পানিতে ভিজেছি, ঘুম নেই, ২৪ ঘণ্টায় হয়তো একবারের জন্যও বসার সুযোগ হয়নি। তবে এমন পরিস্থিতিতে কাজ করতে আমাদের একবারের জন্যও খারাপ লাগেনি। শুধু মনে হয়েছে, মানুষকে উদ্ধার করছি।’