রাজনৈতিক অস্থিরতা-বন্যায় শিশুরা আতঙ্কগ্রস্ত, বলেছেন ৫৫% মানুষ

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় আলোচকেরাছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা শিশুদের মনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। একটি জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৫ শতাংশের বেশি মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা শিশুদের ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হতে দেখেছেন। প্রায় ৩৭ শতাংশ জানিয়েছেন, শিশুদের মধ্যে স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এ ছাড়া শিশুদের মধ্যে শিক্ষায় অমনোযোগ, উচ্ছৃঙ্খলতা, ডিভাইসে আসক্তি, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক মতামত জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতামতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আজ সোমবার প্রতিষ্ঠান দুটি ‘প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন: আমাদের করণীয়’ শিরোনামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য তুলে ধরে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আরও জানানো হয়, শিশুদের মধ্যে যে দৃশ্যমান মানসিক পরিবর্তন এসেছে, সে সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীরা মতামত জানান। এর মধ্যে প্রায় ৩৭ শতাংশ জানিয়েছেন, শিশুদের পড়ালেখায় অমনোযোগী হতে দেখা গেছে। শিশুদের মানসিক ক্ষতিসাধন হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রায় ২৯ শতাংশ। শিশুদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রায় ৮ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ বাড়ানো, স্কুলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করা, খেলার মাঠ ও খেলাধুলার সরঞ্জাম দেওয়া, শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেওয়া, শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোসহ বিভিন্ন সুপারিশ উঠে এসেছে।

সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে দেশের আটটি বিভাগে একটি সাধারণ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত নেওয়া হয়। ১২টি দলভিত্তিক আলোচনায় ৩৬০ জন, ৩০ জন অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতামত এবং ৬০০ জনের উপস্থিতিতে ২টি বিভাগীয় ও ২টি জাতীয় পর্যায়ে সভার মাধ্যমে মতামত সংগ্রহ করা হয়। এতে বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিশুদের মনে প্রভাব ফেলেছে, এমন কিছু ঘটনার মধ্যে রয়েছে—শিক্ষার্থীরা স্কুল ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। মিছিল, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি দেখেছে। রাজপথে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়া দেখেছে বা শুনেছে, যা তাদের মনে আতঙ্কের জন্ম দেয়। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কারফিউ ও অবরোধ কর্মসূচির কারণে ঘরে থাকতে হয়েছে। দেয়াললিখন ও আঁকা ছবিতে সাম্প্রতিক ঘটনা দেখে প্রভাবিত হয়েছে। তারা পরিবারে বা আশপাশে শিক্ষার্থীদের গুরুতর আহত হওয়া বা মৃত্যু দেখেছে। বন্যায় ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও শিক্ষা উপকরণ ভেসে গেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেকোনো বিষয় নিয়ে আন্দোলন করার প্রবণতা বেড়েছে।

সভাপ্রধানের বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী অন্তর্বর্তী সরকারকে শিশুদের জন্য এ মুহূর্তে তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে বলেন। সেটা হচ্ছে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য, উপবৃত্তি ও মিড ডে মিল।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘আমরা এখন কঠিন সময় পার করছি। প্রাথমিক শিক্ষায় পরিবর্তন আসছে। সবাইকে সচেতন থাকা দরকার, যাতে আমরা ইতিবাচক দিকে যেতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্কুলে শরীরচর্চা ও সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার। দৃষ্টিনন্দন প্রাথমিক স্কুল করা হচ্ছে। ১৫০ উপজেলায় মিড ডে মিল চালুর কর্মসূচি শিগগির চালু হবে। পর্যায়ক্রমে সব স্কুলে চালু হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার সমস্যা সমাধানের প্রধান বাধা হচ্ছে কাজ খুব বেশি কেন্দ্রীভূত। এই চক্র ভেঙে কাজ বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মে কোনো তথ্য হালনাগাদ থাকে না। তথ্য হালনাগাদ হলে স্বচ্ছতা থাকত।

সভায় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ঢাকায় ৯টি স্কুলের মাঠ দখল করে পানির ট্যাংক স্থাপন করেছিলেন ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে আটটি মাঠ রয়েছে। অথচ শিক্ষার্থীদের সেখানে খেলতে দেওয়া হয় না। উপবৃত্তি বাড়িয়ে অন্তত ৫০০ টাকা করা উচিত। স্কুলে শিশুদের যেন অভুক্ত থাকতে না হয়, সে জন্য মিড ডে মিল দ্রুত চালু করা উচিত।

রাশেদা কে চৌধূরী স্কুলের পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের বিষয়ে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘২০১২ সালের পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে আমরা কেন ফেরত যাব? ৩২ কোটি টাকার কোচিং–বাণিজ্য হয়। সরকার কেন এটা সমর্থন করবে?’

সভায় মতামত জরিপের তথ্য তুলে ধরেন শিক্ষক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হক। তিনি বলেন, ‘সমস্যা শুধু আমরা শিশুদের বলে থাকি। শিশুদের এসব সমস্যা মা–বাবা, শিক্ষক ও আশপাশের মানুষের কারণে হয়ে থাকে। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্কুলেরও বিনিয়োগ করা উচিত। স্কুলগুলোর এ বিষয়ে কোনো উদ্বেগ নেই। তারা শুধু এ প্লাস পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত।’ শিক্ষাক্রম হুট করে পরিবর্তন না করে অন্তত ২-৩ বছর ধরে তা নিয়ে প্রচার ও মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া চললে তা সবাই সহজে গ্রহণ করবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মুহাম্মদ মুসা বলেন, বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামতে যা উঠে এসেছে, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব একা সরকারের নয় বা অন্য কারও নয়। এসব বাস্তবায়নে সরকার, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), স্কুল, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এডুকেশন ওয়াচের আহ্বায়ক আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে বলেন। তিনি বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী কিছু দেশ শিক্ষায় অনেক এগিয়ে গেছে। কারণ, তারা বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। আমাদের দেশে উল্টো কমছে। ২০১৯ সালে দেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল। এখন সেটা কমে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়েছে।’

অনুষ্ঠানে মঞ্চে থাকা দুই শিশুর একজন মো. আলী হোসেন বলে, সে স্কুলে খেলার মাঠ চায়। তাদের স্কুলের বারান্দা ও শ্রেণিকক্ষে খেলতে হয়। আরেক শিশু আমেনা বলে, সে জেনেভা ক্যাম্পে থাকে। জেনেভা ক্যাম্পের পরিবেশ যেন মাদকমুক্ত থাকে। কারণ, প্রায়ই সেখানে মারামারি লাগায় স্কুলে যেতে তার ভয় লাগে।

সভায় অভিভাবক ও শিক্ষকেরাও তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাশ।