সব ক্ষেত্রে সংস্কারের পর দেশে নির্বাচন হবে

ছাত্র আন্দোলনের সভায় বক্তারা: নওগাঁ, নোয়াখালী, নড়াইল, ঠাকুরগাঁও ও বরগুনায় গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে মতবিনিময় সভা হয়। বরগুনায় সভা চলাকালে মারামারির ঘটনা ঘটেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের। গতকাল নোয়াখালীতেপ্রথম আলো

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এ অর্জন ধরে রাখতে এখন ছাত্র-জনতার ঐক্য ধরে রাখতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে কেউ কোনো ধরনের অপতৎপরতা চালালে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। দেশে এখন যা কিছু হবে, তা ছাত্র-জনতার রায়ের ভিত্তিতেই হবে। সব ক্ষেত্রে সংস্কারের পর দেশে নির্বাচন হবে।

গতকাল শনিবার নওগাঁ, নোয়াখালী, নড়াইল, ঠাকুরগাঁও ও বরগুনায় আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এ কথাগুলো বলেন। ‘গণ-অভ্যুত্থানের প্রেরণায় শহীদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্র-নাগরিক মতবিনিময় সভা’ শিরোনামে এ সভা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সঙ্গে জেলায় জেলায় মতবিনিময় সভা শুরু হয়েছে।

গতকাল বিকেলে নওগাঁ শহরের এ-টিম মাঠে সভা হয়। এতে ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, কোনোভাবেই ছাত্র-জনতার ঐক্য নষ্ট করা যাবে না। তা না হলে আবারও ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান ঘটবে। ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান আর যাতে না ঘটে, সে জন্য রাষ্ট্রের অনেক কিছু সংস্কার প্রয়োজন। ছাত্র-জনতার ঐক্য নষ্ট হলে এসব সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।

মাহিন সরকার আরও বলেন, ‘একটি পক্ষ কিন্তু এ মূহূর্তে এখনো সক্রিয় আছে। তারা এখনো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার দালালেরা এখনো মানুষ হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। শুক্রবারের গোপালগঞ্জের ঘটনাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানাই। আমাদের এখন সজাগ থাকতে হবে, তারা যাতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।’

সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক কুররাতুল আইন কানিজ, সাইফুল ইসলাম, মাসুদ রানা প্রমুখ বক্তব্য দেন।

এর আগে দুপুর ১২টায় নওগাঁ সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের পরিবারে সদস্য ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন সমন্বয়কেরা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে কোনো ধরনের অপতৎপরতা চালালে প্রশাসনের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সমন্বয়ক মো. ওয়াহিদ উজ জামান। গতকাল দুপুরে নড়াইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনেকক্ষে মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন মো. ওয়াহিদ উজ জামান।

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মো. ওয়াহিদ উজ জামান বলেন, ‘আপনারা ছাত্র প্রতিনিধিদের কথা যদি শুনতে চান, তাহলে শুধু ছাত্র পরিচয়টিই যথেষ্ট। আলাদা করে এখানে সমন্বয়ক, সহসমন্বয়কের তালিকা স্থানীয় প্রশাসনের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। সমন্বয়ক হোক, সহসমন্বয়ক হোক, সঠিক পরিচয় হোক, ভুয়া পরিচয় হোক, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। তারা যদি সরকারি কাজে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করে অথবা যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, আপনারা সেই মুহূর্তে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক মাহমুদা সুলতানা রিমি, কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সুলতানা খাতুন, সহসমন্বয়ক সরদার শুভ ও সাঈদ আফ্রিদি এবং নড়াইল জেলার প্রতিনিধি মিনহাজুর রহমান ও হাসিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গতকাল ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দল নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের মাল্টিপারপাস হলরুমে আন্দোলন চলাকালীন আহত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করে।

নোয়াখালীতে আয়োজিত সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেন, ‘আমাদের ভাইয়েরা যে স্বপ্ন নিয়ে জীবন দিয়েছিল, সেই স্বপ্নের এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, শুধু ফ্যাসিবাদ ব্যক্তি হাসিনার উৎখাত নয়, এক যুগ ধরে ফ্যাসিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট সেই কাঠামো ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদের সিস্টেম পরিবর্তন করা।’

গতকাল বিকেলে নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলে (ম্যাটস) মিলনায়তনে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন আবদুল কাদের। তিনি ওই সভায় উপস্থিত ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই ফ্যাসিবাদী কাঠামোকে নস্যাৎ করার। আমরা শুধু বলতে চাই, আমরা আর কোনো ফ্যাসিবাদী সিস্টেম তৈরি করতে দেব না। সাধারণ মানুষের একটি প্রত্যাশার জায়গা আছে। সাধারণ মানুষ যখন তার সরকার গঠন করতে চায়, সে ভোটাধিকার চায়।’

সভায় অন্যদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হামযা মাহবুব, সুমাইয়া আক্তার, সহসমন্বয়ক তাসলিমা নওরিন, খালিদ হাসান, মো. মহিউদ্দীন, জিয়া উদ্দিন, মহিদুল ইসলাম, আলী আহমেদ আরাফ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ ইয়াছিনের মা লাকি বেগম, হাসানের বাবা মামুন উদ্দিন প্রমুখ বক্তব্য দেন।

গতকাল বিকেলে ঠাকুরগাঁওয়ের সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড় মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আয়োজিত মতবিনিময় সভা হয়। এ সভায় অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘আগামীর যে বাংলাদেশ, সে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হবে ছাত্র-জনতার মতামতের ওপর ভিত্তি করে। আমাদের চারপাশে যে সীমান্ত রয়েছে, সে সীমান্তে আমাদের নিরপরাধ ভাইবোন একজনকেও ফেলানীর মতো কাঁটাতারে ঝুলে থাকতে দেখতে চাই না।’ সারজিস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যদি আজকের পর থেকে এমন কোনো ঘটনা ঘটে, এর উপযুক্ত বিচার করা হবে। আর তা না হলে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা, বিজিবি থেকে শুরু করে যারা সম্ভব, তারা সবাই মিলে কীভাবে ওই রাষ্ট্রগুলোকে জবাব দিতে হয়, তা দেখিয়ে দেবে।’

বাংলাদেশে যা কিছু হবে, তা ছাত্র-জনতার রায়ের ভিত্তিতেই হবে—উল্লেখ করে সারজিস আলম বলেন, ‘কোনো পরিবার থেকে নয়, কোনো ফ্যাসিবাদের যে সিস্টেম সেখান থেকে নয়। এখন নাকি মামলা মামলা খেলা চলছে। টাকার বিনিময়ে মামলায় নাম দেওয়া হয়, টাকার বিনিময়ে নাম কাটা হয়। এ জন্য কি আমরা অভ্যুত্থান করেছিলাম।’

এসব অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে সংস্কারের কাজ নিজের ঘর থেকে শুরু করার আহ্বান জানিয়ে সারজিস আলম বলেন, ‘আমরা যে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছি, এ সংস্কার নিজের ঘর থেকে শুরু করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের নিজেদের ভেতরে লুটপাট করা, শোষণ করার যে চিন্তা ঢুকেছে, সেটি থেকে অবশ্যই আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমরা যদি নিজের ঘর থেকে এই নোংরা সিস্টেমগুলোকে, এই মানুষগুলোকে ত্যাগ করতে পারি, তাহলে এ সংস্কার একদিন ঘর থেকে সমাজে পৌঁছাবে, জেলায় পৌঁছাবে, বিভাগে পৌঁছাবে, রাষ্ট্রে পৌঁছাবে।’

সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম, রাকিব রানা, আবু সাইদ, সহসমন্বয়ক জহির রায়হান প্রমুখ বক্তব্য দেন। এর আগে সকালে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে আন্দোলন চলাকালে শহীদ ও আহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা।

বরগুনায় আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘দেশ এখনো ফ্যাসিস্ট, দালাল ও চাঁদাবাজমুক্ত হয়নি। উনসত্তরের অভ্যুথান ব্যর্থ হওয়ার কারণ, যারা বিপ্লব করেছে, তারা রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখার সুযোগ পায়নি। ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুথান ব্যর্থ হবে যারা রাজপথে থেকে আন্দোলন করছে, তারা যদি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ভূমিকা না রাখে। কলেজ বা উপজেলায় সমন্বয়ক পরিচয় দিলে কি আসে যায়, যদি সে চাঁদাবাজি করে। সে তো চাঁদাবাজ। প্রশাসনের কাজ তাদের আটক করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক নয়। এই সরকার রাষ্ট্র, বিচার বিভাগ, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার করবে। সব খাতে সংস্কারের পর দেশে নির্বাচন হবে।

গতকাল বেলা তিনটায় বরগুনা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় একই স্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বকদের সঙ্গে বরগুনা জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিনিময় সভা চলাকালে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়েছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]