ফিরে দেখা
বাংলাদেশে প্রথম এসে ভুট্টো সংবর্ধনা যেমন পেয়েছিলেন, দেখেছিলেন বিক্ষোভও
পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। তারপরেই বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে। এরপর ২৭ জুন বাংলাদেশে এসেছিলেন একাত্তরের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কুশীলব জুলফিকার আলী ভুট্টো। কেমন ছিল সেই সফর? আজকের ফিরে দেখা সেই সফর নিয়েই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি ব্যক্তির প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর ছিল ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন। ঠিক ৫০ বছর আগে এই দিনে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টোর সফরটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল ভারত। ইন্ধন পেয়েছিল দেশে থাকা পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক শক্তি।
এর আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো সর্বশেষ ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি। ২৬ মার্চ ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তানের করাচি যান। আগের দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ সকালে ঢাকা ছেড়েছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের একজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি। করাচি পৌঁছানোর পর জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’
জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে। তিন দিনের সফর শেষে ভুট্টো পাকিস্তান ফিরে গেলে ৩০ জুন দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামজুড়ে শিরোনাম ছিল: ‘বঙ্গবন্ধু-ভুট্টো আলোচনা ব্যর্থ।’
ভুট্টো অখণ্ড পাকিস্তানের জ্বালানিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চার দিন পর ২০ ডিসেম্বর তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ওই পদে ছিলেন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। তারপর ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন। ১৯৭৭ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। হত্যার অভিযোগে বিচার শেষে ১৯৭৯ সালে রাওয়ালপিন্ডির কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ইতালির বিখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফাল্লাচি লিখেছেন, ‘ভুট্টো ধূর্ত, শিয়ালের মতো বুদ্ধিমান। ভুট্টোকে দেখতে একজন ব্যাংকারের মতো, যে কাউকে তিনি দেখতে চান তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য।’ ১৯৭২ সালের এপ্রিলে ওরিয়ানা ফাল্লাচি করাচিতে ভুট্টোর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে ভুট্টো বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মিথ্যুক। বাংলাদেশে নারী ধর্ষিত হয়েছে, এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। বাংলাদেশে ৩০ লাখ শহীদের তথ্য অতিরঞ্জন। বাংলাদেশ ভারতের স্যাটেলাইট, শিগগিরই সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট হবে।’ ওই সাক্ষাৎকারে ভুট্টো আরও বলেছিলেন, ‘তিনি বাংলাদেশ শব্দটা উচ্চারণ করেন ঘৃণাভরে।’
ভুট্টোর সফরের পটভূমি
১৯৭৩ সালের শেষ নাগাদ শতাধিক দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পাকিস্তান তখনো স্বীকৃতি দেয়নি। বলা হয়, বাংলাদেশের কেউ কেউ পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন। একই সময়ে বাংলাদেশেরও ইসলামি দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা অনেকে বলতে থাকেন।
অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সে (ওআইসি) যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি একটি প্রতিনিধিদল ১৯৭৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা এসে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানায়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক-এ এটা নিয়ে বলা হয়, একটি বিশেষ প্রস্তাব নিয়ে দলটি বাংলাদেশে এসেছিল। দলটি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করে। এরপর ওআইসি মহাসচিবসহ চারজন সদস্য কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে বিশেষ বার্তা নিয়ে লাহোর চলে যায়। তারপরেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তান ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া ১১৭তম দেশ। একই দিন স্বীকৃত দেয় তুরস্ক ও ইরান। এরপরই ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনকে নিয়ে লাহোর যান। লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেওয়া, ওআইসির সদস্য হওয়া ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি ছিল একসূত্রে গাঁথা।
ওই সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান বঙ্গবন্ধু।
বিমানবন্দরে ছিল জোরদার নিরাপত্তা
২৭ জুন প্রায় ১০০ প্রতিনিধি নিয়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। দৈনিক ইত্তেফাক-এ লেখা হয়, ‘সবার আগে বাংলার মাটিতে তাঁহাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনাব ভুট্টো তাঁহাকে জড়াইয়া ধরেন ও কোলাকুলি করেন।’সম্মিলিত বাহিনী প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। তার আগে ১৯ বার তোপধ্বনি করা হয় এবং দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। এরপর ভুট্টো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রধান এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে করমর্দন করেন। বাংলাদেশের ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিতও অভ্যর্থনা সারিতে উপস্থিত ছিলেন।
ভুট্টোর আগমন উপলক্ষে বিমানবন্দরে সাধারণ মানুষের ভিড় ছিল। অনেকে নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। পুলিশ একপর্যায়ে লাঠিপেটা করে। এরপর ভুট্টোকে নিয়ে মোটর র্যালি যখন এয়ারপোর্ট রোড হয়ে বঙ্গভবনের দিকে যাচ্ছিল, তখন মানুষজন রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ভুট্টোকে অভিনন্দন জানান ও স্লোগান দিতে থাকেন।ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত ‘লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড’ গ্রন্থে জে এন দীক্ষিত লিখেছেন, মোটর র্যালির সময় ভারতীয় হাইকমিশনারের গাড়ি আক্রমণের মুখে পড়ে।
সম্মেলন সফল হয়নি
ভুট্টোর সফরের উদ্দেশ্য কী, ২৫ জুন বিমানবন্দরে সাংবাদিকেরা এই প্রশ্ন করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনকে। কুয়ালালামপুর অনুষ্ঠিত ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে কামাল হোসেন দেশে ফিরছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির জন্য যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই শীর্ষ বৈঠক বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কিছু দাবি ছিল। সোনার মজুত, পাকিস্তানি ন্যাশনাল শিপিংয়ের সম্পদ, বেসামরিক বিমানের সম্পদ—এসবের ভাগ দিতে হবে বাংলাদেশকে। সামরিক সরঞ্জামও ভাগাভাগি করতে হবে। ইসলামাবাদ ও করাচিতে কেন্দ্রীয় রাজধানী নির্মাণে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পাকিস্তানে বন্দী থাকা বাঙালিদের মুক্তির বিষয়টিও দাবির তালিকায় ছিল। আলোচনা হয়েছিল বাংলাদেশে থাকা পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়া নিয়েও।
ভুট্টোর সঙ্গে সফরের প্রথম দিনেই বঙ্গবন্ধুর একান্ত বৈঠক হয়। নৈশভোজ, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, নাগরিক সংবর্ধনা এবং সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।নৈশভোজে দেওয়া ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভুট্টোর উদ্দেশে বলেন, ‘এ দেশের মানুষ একটি বৃহত্তর লক্ষ্য ও মহত্ত্বর পরিণতিতে পৌঁছানোর জন্য যে অকৃত্রিম ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে তা অতি বিরল। কিন্তু নিষ্পত্তির ও সমঝোতার এই প্রচেষ্টা কখনো একতরফা হতে পারে না। সত্যিকারের নিষ্পত্তির স্বার্থে পাকিস্তানের জনগণ ও সরকারকে ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংঘর্ষ থেকে উদ্ভূত অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হবে।’
নাগরিক সংবর্ধনায় এবং সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টো ১৯৭১ সালে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। ২৯ জুন দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি দাবি করেন, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সুরক্ষার ব্যাপারে কোনো কমতি ছিল না। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা থেকে করাচি গিয়ে ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে’ এই বক্তব্যকে মানুষ ভুল ব্যাখ্যা করে বলে ভুট্টো এ দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে দায় ও পরিসম্পদ বণ্টন এবং বাংলাদেশে থাকা পাকিস্তানি অবাঙালি নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ভুট্টোর নীতিগত অসম্মতির কারণে বাংলাদেশ-পাকিস্তান শীর্ষ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, এ ব্যাপারে ভুট্টো আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দায় ও পরিসম্পদ বণ্টনের আগে এ সম্পর্কিত আইন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো বিবেচনা করতে হবে।
আর পৃথকভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, শুরু থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও পাকিস্তান তাতে সাড়া দেয়নি। পাকিস্তান অযৌক্তিক মনোভাব প্রকাশ করেছে।
২৯ জুন ভুট্টো তাঁর দলবল নিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। দেশের সংবাদপত্রে লেখা হয়: ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান শীর্ষ বৈঠক ব্যর্থ হইলেও অতিথি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনে বাংলাদেশ কোনো ত্রুটি করে নাই।’
খুনি ভুট্টো ফিরে যাও
বাংলাদেশ সফরের দ্বিতীয় দিন ২৮ জুন সকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করতে গেলে বিক্ষোভের মুখে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের হাতে কালো পতাকা ও নানা ধরনের প্ল্যাকার্ড ছিল। বিক্ষোভকারীরা ‘খুনি ভুট্টো ফিরে যাও’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। তাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল: ‘স্মৃতিসৌধের অবমাননা বাঙালিরা সইবে না’, ‘গো ব্যাক কিলার ভুট্টো’ ইত্যাদি।
সাভারে ভুট্টোর মাথায় ছিল গলফ টুপি। পুষ্পমাল্য অর্পণের সময় তিনি টুপি খোলেননি। অনেকে ধারণা করেন, পাকিস্তানিদের হাতে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের সম্মান জানাতে তিনি আন্তরিকভাবে সম্মত ছিলেন না। টুপি তিনি ইচ্ছা করেই খোলেননি।
এ নিয়ে ২৯ জুন দৈনিক বাংলায় লেখা হয়, ‘জনাব ভুট্টো বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করতে গিয়েছিলেন। পুষ্পমাল্য অর্পণের সময় তিনি পরে ছিলেন উজ্জ্বল সবুজ রঙের একটি গলফ ক্যাপ, আর সঙ্গে ম্যাচ করা টাই ও বুকপকেটে চূড়া বার করা রুমাল। কিন্তু তাঁর এই রঙচঙা সাজপোশাক পবিত্র স্মৃতিসৌধ এবং তার পরিবেশের পক্ষে বিসদৃশ। বিশেষ করে জনাব ভুট্টো মাথায় ওই সবুজ গলফ টুপি পরেই যখন পুষ্পমাল্য অর্পণ করছিলেন এবং সেনাবাহিনীর বিউগলে যখন করুণ সুরে বাজানো হচ্ছিল। ওই সময় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ছিল। জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণের পরমুহূর্তেই জনাব ভুট্টো তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগের জন্য পা বাড়ান। কিন্তু বাংলাদেশের একজন প্রোটোকল অফিসার এসে তাঁর হাত ধরে জানান যে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি। এরপর সেনাবাহিনীর ব্যান্ডে করুণ সুর বাজানো হয় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত হয়ে আসে। জনাব ভুট্টো টুপি না খুলেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর জনাব ভুট্টো জাতীয় স্মৃতিসৌধের মডেলটি দেখাতে গেলে তিনি তা না দেখে হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য এগিয়ে যান। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্মরণী খাতায় এবং বেতার ভাষ্যকারের কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে সোজা এগিয়ে যান হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য।’
স্মৃতিসৌধ থেকে ফেরার সময়ও বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল।
ক্ষুব্ধ ছিল ভারত
পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার সময় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন সুবিমল দত্ত। সুবিমল দত্তের সরকারি চাকরির মেয়াদ আরও এক বছর ছিল। কিন্তু তিনি তা আর করতে চাননি। এর কারণ জানা যায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত জে এন দীক্ষিতের লেখা ‘লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড’ গ্রন্থে।
সুবিমল দত্তকে উদ্ধৃত করে বইটিতে বলা হয়েছে, তিনি (সুবিমল দত্ত) হাইকমিশনার থাকলে রীতি অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীতে স্বাগত জানাতে তাঁকেও অভ্যর্থনাকারী দলের সঙ্গে বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতে হবে এবং ভুট্টোর সঙ্গে হাত মেলাতে হবে, যে হাতে বাংলাদেশের মানুষের রক্ত লেগে আছে। পরিস্থিতিটা তার জন্য গভীর বিরক্তির সৃষ্টি করে। সুবিমল দত্ত চাননি তাঁর কারণে ভারত বা বাংলাদেশ সরকার কোনো ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ুক। তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে যান।
সুবিমল দত্তের জায়গায় ভারতীয় হাইকমিশনের দায়িত্বে ছিলেন জে এন দীক্ষিত। বিমানবন্দরে ভুট্টোর সংবর্ধনা দলে তাঁকে থাকতে হয়েছিলে। জে এন দীক্ষিত ভুট্টোর হাতে হাত মেলান, তাঁদের মধ্যে কথাও হয়।
জে এন দীক্ষিত লিখেছেন, তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে ভুট্টোকে স্বাগত জানাতে মানুষের ভিড় ছিল প্রচুর। মানুষজন ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান মৈত্রী জিন্দাবাদ’, ‘জুলফিকার আলী ভুট্টো জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছিল। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে এলে তাঁর গাড়ি আক্রান্ত হয়, রাস্তার মানুষ ভারতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলে। মানুষ ভারত সরকার ও ভারতীয় দূতাবাসবিরোধী স্লোগান দিতে থাকে। এরপর দিল্লিতে টেলিগ্রাম পাঠানোর জন্য জে এন দীক্ষিত অফিসে আসেন, তিনি ছিলেন ক্রোধান্বিত, তাঁর চোখে পানি।
ভুট্টোর এই সফর এমন সময় হয়েছিল যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছিল। দেশে খাদ্যের মজুত ফুরিয়ে আসছিল, কয়েক মাস পরেই দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। মানুষের অসন্তোষও বাড়ছিল। স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী যে শক্তি দেশে ছিল, তারা ইন্ধন পেয়েছিল ভুট্টোর এই সফর থেকে। সফর থেকে বাংলাদেশের তেমন কোনো লাভ হয়নি। পাকিস্তান আজও পাওনা শোধ করেনি। এমনকি অবাঙালি ও পাকিস্তানে ফেরত ইচ্ছুকদের নিয়েও যায়নি তারা।