হইহুল্লোড় আর খেলাধুলায় আনন্দে এক দিন

সপ্তাহের শেষ দিন। কর্মব্যস্তময় সকালের শুরু। ব্যস্ত রাজধানীর মানুষগুলো ছুটে চলছে যে যার মতো। বনানী ২৭ নম্বরে অবস্থিত কামাল আতাতুর্ক পার্কের মাঠেও ছিল কিছু মানুষের ছুটে চলা। তবে সে ছুটে চলার মধ্যে ছিল আনন্দ, ছিল উচ্ছ্বাস। ঢাকার গুলশানে অবস্থিত ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল গতকাল (২৫ জানুয়ারি) বৃহস্পতিবার। খুদে শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেতে ছিল বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়।

আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে...
কামাল আতাতুর্ক পার্কের মাঠে অনুষ্ঠিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো অংশ নিতে এসেছিল গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী জিনাত তাসনিম। মোট তিনটি খেলার অংশ নিয়ে বিস্কুট দৌড়ে তৃতীয় হয় সে। তৃতীয় পুরস্কার পেয়েও পুরো মাঠময় আনন্দে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল খুদে এ ক্রীড়াবিদ।

‘আমি এরারই প্রথম কোনো পুরস্কার পেলাম। আমি খুশি, বাবা-মা খুশি, সবাই খুশি...।’ বলেই আবার ভোঁ-দৌড় দেয় জিনাত। তার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া পুরস্কার না পাওয়া শিক্ষার্থীরাও।

১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েই ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার করে ওঠে আবিদ। পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া আবদুল্লাহ আল আবিদ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে বলে, ‘বাবা-মাকে বলেছিলাম আমি প্রথম হব, হয়েছিও।’

পুরস্কারজয়ীদের তো বটেই, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সব ছাত্রছাত্রীর চোখে-মুখে ছিল উৎসবের আমেজ।

১৭৪ পদকের লড়াই
সারা দিনব্যাপী গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মোট ৪০০ জন খুদে শিক্ষার্থী মোট ৫৮টি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ছিল ৩০, ৪০, ৫০, ৭৫ ও ১০০ মিটার দৌড়, বিস্কুট দৌড়, ঝুড়িতে বল সংগ্রহ, বেলুন ফাটানো দৌড়, ব্যাঙ দৌড়, মোরগ লড়াই, বল সংগ্রহ দৌড়, হাঁড়ি ভাঙা, ভারসাম্য দৌড়, বস্তা দৌড় ও রিলে দৌড়। প্রতিটি খেলায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে ছিল উচ্ছ্বাস। কে পুরস্কার পেল আর কে পেল না—তা নিয়ে যেন কারও চিন্তা নেই।

আনন্দ ভাগাভাগি
প্রতিযোগিতার এ আয়োজনে হার-জিত থাকলেও সব শিক্ষার্থী আনন্দকে ভাগ করে নিয়েছে। আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন অভিভাবকেরাও। ছেলের সাফল্যে আনন্দ করেছেন মা। আবার বাবা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন মেয়ের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পুরস্কার না পেয়েও মাতিয়ে রেখেছিল পুরো অনুষ্ঠানস্থল।

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান ওমর চেয়ারে বসে খেলা উপভোগ করছিল। গলায় ঝোলানো একটি মেডেল। জানতে চাই, কোন খেলায় পুরস্কার পেয়েছ?

উত্তরে ওমর বলল, ‘আমি কোনো খেলায় পুরস্কার পাইনি। ক্লাসের বন্ধু পুরস্কার পেয়েছে, ওই মেডেল পরেই আনন্দ করছি।’

শুধু ওমর ফারুকই নয়, পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ৪০০ জন শিক্ষার্থীই। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নূর সাইবা তিনটি খেলায় অংশ নিয়ে বিস্কুট দৌড়ে তৃতীয় হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির নাফিজা নাজনীন ৫০ মিটার দৌড়, বিস্কুট দৌড় ও ব্যাঙ দৌড় প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে। আবার মো. ইব্রাহিম কোনো খেলাতেই পুরস্কার পায়নি। কিন্তু তাদের আনন্দ দেখে বোঝার উপায় নেই কে পুরস্কার পেয়েছে আর কে পায়নি।

উৎসাহ বেশি অভিভাবকদের
দ্বিতীয় শ্রেণিপড়ুয়া যমজ সন্তান মুসাইদ রাহিব ও মুসাদিক রাইদকে নিয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এসেছেন ব্যাংক এশিয়ায় কর্মরত মা নুসরাত জাহান। অফিসের বসকে বলে সন্তানদের নিয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এসেছেন জানিয়ে নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় প্রায় সব স্কুলেই মাঠ ছিল। এখন শহরের বেশির ভাগ স্কুলেই মাঠ নেই। যত বেশি শিক্ষার্থীকে মাঠে নিয়ে যাওয়া যাবে, ততই তারা খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। তাদের মানসিক বৃদ্ধিও ভালো হবে।’

দুই সন্তান নার্সারিতে পড়া মোহাইন ইবনে আমিন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া শুবাহানা বিনতে আমিনকে নিয়ে এসেছিলেন ব্যবসায়ী আমি মো. ফখরুল।

এ আয়োজন সম্পর্কে তিনি বলেন, গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও বেশ গুরুত্ব দেয়। স্কুল-মাঠ না থাকলেও তারা স্কুল ভবনে খেলাধুলার ব্যবস্থা করে। সপ্তাহে এক দিন স্কুলটি স্পোর্টস ডে হিসেবে পালন করে। এটা বেশ ভালো একটি উদ্যোগ।

মা, স্ত্রী ও বোনসহ পুরো পরিবার নিয়ে এসেছিলেন জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইওএমে কর্মরত মো. আশরাফুল ইসলাম। তাঁর সন্তান আয়শা বিনতে আশরাফ দুটো খেলায় অংশ নিয়ে দুটোতেই পুরস্কার পেয়েছে। সন্তানের ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশ নেওয়ার সময় উত্তেজনায় তিনি পুরোটা সময় উৎকণ্ঠায় ছিলেন। আশরাফুল বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, আমি নিজেই স্কুল স্পোর্টস ডে-তে অংশ নিচ্ছি। সন্তানের প্রতিটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া এবং পুরস্কার পাওয়াকে আমি উদ্‌যাপন করছি।’

ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই লক্ষ্য
বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটি শিক্ষার্থীদের ভালো শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত করছে। তারই ধারাবাহিকতায় স্পোর্টস ডে-তে শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় সমাজের আলোচিত মানুষদের। স্পোর্টস ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশের জাতীয় ও স্কুলের পতাকা উত্তোলন করেন বাংলাদেশে ক্রিকেট দলের সাবেক দুই অধিনায়ক তামিম ইকবাল খান, মোহাম্মদ আশরাফুল, বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সদস্য জাহানারা আলম এবং সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খান।

গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ জামান বলেন, ‘নৈতিক শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ রয়েছে খেলাধুলা ও পবিত্র কোরআন হিফজ করার। শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে শরীরচর্চা এবং খেলাধুলার বিকল্প নেই। শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে খেলাধুলা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে খেলাধুলা। তাই আমরা পর্যাপ্ত খেলাধুলার ব্যবস্থা রেখেছি।’

দিনব্যাপী প্রতিযোগিতা শেষে জয়ীদের মাঝে পুরস্কার তুলে দেন গাইডেন্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পরিচালনা পর্ষদসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা।