ঢাকায় মশার ১ ভাগ এডিস, নিয়ন্ত্রণে শতকোটি টাকা খরচ করেও সুফল মিলছে না
ঢাকা শহরে যে মশা রয়েছে, তার ৯৯ শতাংশ কিউলেক্স আর ১ শতাংশ এডিস। ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী এডিস মশা। এই এডিস মশা নির্মূলে গত অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) খরচ করেছে ১২০ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছর ১৯৯ কোটি টাকা খরচের বাজেট করেছে। অথচ কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও ডেঙ্গু নাম কমে; বরং ছড়িয়ে পড়ছে।
‘ডেঙ্গু মোকাবেলায় বছরব্যাপী আমাদের প্রস্তুতি এবং করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে। সোমবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে নগর ভবনে এ বৈঠকের আয়োজন করে ডিএনসিসি। বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর ও জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
বৈঠকে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী। তাতে উঠে আসে, মশকনিধনে ২০২২–২৩ অর্থবছরে ডিএনসিসি ১২০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে এবং চলতি অর্থবছর ১৯৯ কোটি টাকা খরচ করবে। এভাবে বছর বছর এত খরচের পরও অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসচেতনা ও জনসম্পৃক্ততার ঘাটতি, নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিক এবং কর্মচারীদের জ্ঞানের অভাব ও অসহযোগিতা, পরিত্যক্ত ও অপরিকল্পিত ছাদবাগান, ভবনের বেজমেন্টে পার্কিংয়ে জমে থাকা পানি এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী সংখ্যার তথ্যের অপ্রতুলতা—এই ছয় কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে উপস্থাপনায়।
মশকনিধনের ওষুধ ছিটানোর পর তার কী ফলাফল, তা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে পারেননি বলে স্বীকার করেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দুর্বলতা। আমরা একটি মূল্যায়ন কমিটি করব। সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।’ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলতি মাসের শেষ দিকে ম্যাজিস্ট্রেটসহ মাঠে নামবেন বলে জানান তিনি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়ের অভাব রয়ে গেছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ডাকলে বোধহয় ভালো হতো। এটা ঢাকা উত্তর সিটির একার কাজ নয়। বিমানবন্দর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ অনেক সংস্থা রয়েছে। সবার মধ্যে সমন্বয় দরকার। দেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। সবার সমন্বিত পদক্ষেপ যদি না হয়, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাসার বলেন, ঢাকায় এখন ৯৯ শতাংশ কিউলেক্স ও ১ শতাংশ এডিস মশা। এই অল্পসংখ্যক এডিস মশার ৪৩ শতাংশ থাকে বহুতল ভবনের বেজমেন্টে, ২৩ শতাংশ থাকে নির্মাণাধীন ভবনে এবং বাকিগুলো থাকে ড্রামে থাকা পানিতে, বালতিতে জমিয়ে রাখা পানিতে, ভবনের ওয়াসার মিটারের নিচের চৌবাচ্চায়, ফুলের টবসহ অন্যান্য জায়গায়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এডিস মশাকে অন্য মশা থেকে আলাদা করতে হবে এবং এদের নির্মূলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের মশকনিধনকর্মীদের সমালোচনা করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবির মনে করেন, শুধু নগর পরিচ্ছন্ন করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সিটি করপোরেশন ও কীটতত্ত্ববিদ এবং নাগরিকদের ভূমিকা রাখতে হবে।
ডিএনসিসি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা করেছে, যা এ বৈঠকে তুলে ধরা হয়। এ কর্মপরিকল্পনার সীমাবদ্ধতার জায়গা তুলে ধরেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ। তিনি বলেন, কর্মপরিকল্পনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ কতটুকু কমিয়ে আনা হবে, তার উল্লেখ নেই। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
বছর বছর এত খরচ করার পরও কেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না, সে প্রসঙ্গে বে–নজির আহমেদ বলেন, সিটি করপোরেশনের কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা নেই। কীটতাত্ত্বিক না থাকলে মশকনিধন করতে গিয়ে কর্মীরা ‘হাতুড়ে ডাক্তারের’ মতো আচরণ করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এডিস মশা কোথায় জন্মে, কোথায় দেখা যায়, এদের খাদ্যাভাস কেমন—এসব বিষয়ে সিটি করপোরেশনের মশকনিধনকর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বলে মনে করেন ডিএনসিসির কীটতত্ত্ববিদ মো. তায়েজুল ইসলাম।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক গোলাম সারোয়ার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার পরিচালক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন ও অতিরিক্ত উপপরিচালক সুব্রত কুমার দাস, আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী রাশেদুল হক, প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী প্রমুখ।