স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এসেনসিয়াল ড্রাগসে ৩ হাজারের বেশি বাড়তি লোক

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) উৎপাদনক্ষমতা অনুযায়ী জনবল দরকার সর্বোচ্চ আড়াই হাজার। কিন্তু সেখানে কাজ করেন ৫ হাজার ৬০০ মানুষ। তিন হাজারের বেশি বাড়তি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক এহসানুল কবিরের সময়। অভিযোগ আছে, অর্থের বিনিময়ে বাড়তি নিয়োগ হয়েছে।

ইডিসিএলে শুধু নিয়োগ নয়, অনিয়ম–দুর্নীতি হয়েছে মালামাল ক্রয় ও ব্যবসার ক্ষেত্রেও। শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে নিজেরাই ইডিসিএলের সঙ্গে ব্যবসা করেছেন। নতুন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তিনি যেন দেশ ত্যাগ করতে না পারেন, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এহসানুল কবির ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন ২ অক্টোবর। পরদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন এমডি নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।

এহসানুল কবির ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন ২ অক্টোবর। পরদিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন এমডি নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।

চর্মরোগবিশেষজ্ঞ এহসানুল কবির আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তিনি এমডি হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৪ সালে। বর্তমানে তিনি লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক।

বর্তমানে ইডিসিএলে এমডির দায়িত্ব আছেন পরিচালন বিভাগের পরিচালক মো. আব্দুল হামিদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান না। তিনি এহসানুল কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও এহসানুল কবিরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

চর্মরোগবিশেষজ্ঞ এহসানুল কবির আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তিনি এমডি হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৪ সালে। বর্তমানে তিনি লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক।

প্রায় ৩ হাজার ১০০ বাড়তি জনবল

ইডিসিএল নিজের কারখানায় উৎপাদন করে সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ করে। সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা হাসপাতাল, জেলা বা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ করে ইডিসিএল। সরকারি হাসপাতালের ওষুধের সব চাহিদা ইডিসিএল পূরণ করতে পারে না। হাসপাতালগুলোকে বাজার থেকে ওষুধ কিনতে হয়। আবার বাজারে ইডিসিএলের ওষুধ বিক্রি হয় না। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ইডিসিএল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ওষুধ সরকারি হাসপাতালে দিয়েছিল।

বাজারে একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি ওষুধ বিক্রি করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে তারা ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি করেছেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে এক হাজারের কম মানুষ কাজ করেন।

বাড়তি লোকবলের কারণে নানাবিধ সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, তাঁদের বেতন–ভাতায় বিপুল অর্থ পরিশোধ করতে হয়। দ্বিতীয়ত, অফিসে ও কারখানায় অনেক মানুষ বেকার ঘোরার কারণে কাজের পরিবেশ নিম্ন পর্যায়ে। তিন বছর আগে করোনা মহামারির সময় একজন নারী কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, এক কক্ষে অনেকে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে হয় বলে তিনি অফিস করতে ভয় পান।

২৮ সেপ্টেম্বর ইডিসিএলের সংশ্লিষ্ট শাখার সূত্রে জানা গেছে, এহসানুল কবির এমডির দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানে ২ হাজার ৫৭৭ জন কাজ করতেন। তখনো জনবল প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ছিল। তারপরও নিয়মিতভাবে মানুষ বাড়ানো হয়েছে। এমডি, ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক লীগের নেতারা মিলে একটি শক্তিশালী চক্র এখানে কাজ করেছে। গত ১০ বছরে আরও ৩ হাজার ১০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সময় দুটি জেলার মানুষ এখানে বেশি কাজ পেয়েছে।

অভিযোগ আছে, প্রতিটি নিয়োগ থেকে তাঁরা ৫০ হাজার থেকে দুই–তিন লাখ টাকা করে নিয়েছেন। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, লাভ যদি না থাকবে, তাহলে বাড়তি লোক কেন নিয়োগ দেওয়া হবে?

বাড়তি লোকবলের কারণে নানাবিধ সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, তাঁদের বেতন–ভাতায় বিপুল অর্থ পরিশোধ করতে হয়। দ্বিতীয়ত, অফিসে ও কারখানায় অনেক মানুষ বেকার ঘোরার কারণে কাজের পরিবেশ নিম্ন পর্যায়ে। তিন বছর আগে করোনা মহামারির সময় একজন নারী কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, এক কক্ষে অনেকে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে হয় বলে তিনি অফিস করতে ভয় পান।

আমি জানতাম না চাকরিবিধি অনুযায়ী আমার ব্যবসা করা নিষেধ। যখন জেনেছি, তখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা অন্যের নামে করে দিয়েছি। এখন কোনো ব্যবসা নেই।
ইডিসিএলের মনোয়ারুল আমিন

নিজ প্রতিষ্ঠানেই ব্যবসা

মনোয়ারুল আমিন বর্তমানে ইডিসিএলের পরিকল্পনা শাখার ব্যবস্থাপক। তিনি ফার্মা কেমিক্যালস লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একজন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ায় নিষেধ আছে। শুধু তা–ই নয়, তিনি ফার্মা কেমিক্যালসের হয়ে ব্যবসা করেছেন ইডিসিএলের সঙ্গে। ফার্মা কেমিক্যালস ওষুধ তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ করেছে ইডিসিএলে। অভিযোগ আছে, ফার্মা কেমিক্যালসকে ব্যবসা করতে দেওয়ার বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা পেতেন সদ্য সাবেক এমডি।

২৯ বছর ধরে ইডিসিএলে চাকরি করছেন মনোয়ারুল আমিন। ইডিসিএলের সঙ্গে ব্যবসা করার কথা স্বীকার করে ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জানতাম না চাকরিবিধি অনুযায়ী আমার ব্যবসা করা নিষেধ। যখন জেনেছি, তখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা অন্যের নামে করে দিয়েছি। এখন কোনো ব্যবসা নেই।’

ব্যবসা করার অভিযোগে মনোয়ারুল আমিনসহ দুজনকে সম্প্রতি সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে।

এদের ওষুধ তৈরি করে অন্যরা

ইডিসিএলের কারখানা ও প্রতিষ্ঠান আছে পাঁচ জায়গায়। ওষুধ তৈরি হয় ঢাকা, বগুড়া ও গোপালগঞ্জের কারখানায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব কারখানায় অনেক যন্ত্র পড়ে থাকে। যন্ত্রগুলোর পূর্ণ ব্যবহার হতে দেখা যায় না। এ ছাড়া কনডম তৈরি হয় খুলনার কারখানায়। এ কারখানার জন্য রাবার উৎপাদিত হয় টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায়।

ইডিসিএল নিজের কিছু ওষুধ অন্যকে দিয়ে বা অন্যের কারখানায় তৈরি করে নেয়। এই পদ্ধতি ‘টোল ম্যানুফ্যাকচারিং’ নামে পরিচিত। ওষুধের মোড়কে প্রস্তুতকারী হিসেবে ইডিসিএলের নাম উল্লেখ থাকলেও ওষুধ তৈরি হচ্ছে অন্য প্রতিষ্ঠানে। এ রকম চারটি প্রতিষ্ঠানের নাম জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে চারটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলের ৬০০ কোটি টাকার ওষুধ তৈরি করে দিয়েছে। আর্থিক লাভের বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলকে ওষুধ তৈরি করে দেয়। ইডিসিএলের ভেতরের একটি বিশেষ চক্র এই টোল ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে। নিজেদের সক্ষমতা না বাড়িয়ে, বর্তমান ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার না করে তারা বছরের পর বছর ধরে অন্যের কারখানায় নিজের ওষুধ তৈরি করছে।

এ ব্যাপারে ইডিসিএলের ব্যবস্থাপক (বিপণন) জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের স্থানের সংকট আছে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নেই। সেই কারণে আমাদের টোল ম্যানুফ্যাকচারিং করতে হয়।’

যথেচ্ছ নিয়োগ, অবৈধ ব্যবসা, আরও নানা দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করে রেখেছে। এটা আর চলতে দেওয়া যায় না। সময় এসেছে প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজানোর। পাশাপাশি দুর্নীতি–অনিয়মের তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন

নিয়োগ চলছেই

২৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক এস এম আহসানের সই করা চিঠি পাঠানো হয় বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার আহসেদপুর গ্রামের মো. নাঈম ইসলামের কাছে। তাঁকে ‘প্রকৌশল হেল্পার’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইডিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরও দেড় শর বেশি নিয়োগ হয়েছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে।

৫ আগস্টের পর নতুন সরকারের সময় কত নিয়োগ হয়েছে, তা মনে করতে পারেননি এস এম আহসান। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন নিয়োগ বন্ধ।’

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলে আসছেন, ইডিসিএলকে শক্তিশালী করতে হবে। আধুনিক ব্যবস্থাপনায় এনে এর উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে হবে। উৎপাদনে ওষুধের ধরন ও পরিমাণ বাড়ালে বাজারে ওষুধের দামে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। মানুষ সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে বেশি ওষুধ পাবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যথেচ্ছ নিয়োগ, অবৈধ ব্যবসা, আরও নানা দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করে রেখেছে। এটা আর চলতে দেওয়া যায় না। সময় এসেছে প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজানোর। পাশাপাশি দুর্নীতি–অনিয়মের তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।