দৈনন্দিন জীবনে নানা কারণে, বিশেষ করে ব্যবসা, লেনদেন বা অঙ্গীকার—যেকোনো বিষয়ে চুক্তির প্রয়োজন হতে পারে। টাকা দেওয়া–নেওয়া থেকে শুরু করে অংশীদারি ভিত্তিতে কোনো কাজ বা ব্যবসা করা কিংবা কোনো কিছুতে যৌথ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চুক্তিনামা সম্পাদন করতে হয়। বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট কেনাবেচার সময়ও চুক্তি করার প্রয়োজন হতে পারে। ভূমির মালিক এবং ডেভেলপারের মধ্যে চুক্তি, কোনো স্থাপনা নির্মাণে জমির মালিকের সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণের জন্য চুক্তিপত্র সম্পাদন বাধ্যতামূলক। এমনকি বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রেও চুক্তিনামা সম্পাদন করা জরুরি। এত কাজে যে চুক্তির প্রয়োজন হয়, তার জন্য আছে কিছু নিয়মকানুন। যেকোনো চুক্তি বিধিবিধান মেনে করতে হবে। চুক্তিনামা একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অনেক সময় নির্দিষ্ট বিধিবিধান না মেনে চুক্তি করার কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে। চুক্তি যথাযথ না হলে আইনি প্রতিকার পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয়।
চুক্তি কী
সাধারণ অর্থে চুক্তি হলো একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে যৌথভাবে সম্পাদিত কোনো অঙ্গীকার, যেখানে বস্তুগত স্বার্থ জড়িত থাকে। আইনের ভাষায় বৈধ চুক্তি হতে হলে কিছু উপাদান থাকতে হয় যেমন কোনো বৈধ পক্ষ দ্বারা প্রস্তাব এবং অপর পক্ষ দ্বারা তা গ্রহণের অঙ্গীকার থাকতে হবে এবং তা বৈধভাবে বলবৎযোগ্য হতে হবে। কোনো অবৈধ চুক্তি শুরু থেকেই বাতিল বলে গণ্য হয়। চুক্তির পক্ষগণকে হতে হবে সাবালক ও সুস্থ মস্তিষ্কের। চুক্তিতে আইনগত প্রতিদান এবং আইনের দ্বারা কার্যকর করার উপাদান থাকতে হবে।
কেমন হবে চুক্তিনামা
চুক্তি করতে হলে যোগ্যতম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তথা পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে খেয়াল রাখতে হবে, এ চুক্তি করতে গিয়ে কোনো অপূর্ণতা যেন না থাকে। ব্যবসার জন্য হলে তা ছোট হোক আর বড় হোক, চুক্তিতে কার কী রকম দায়দায়িত্ব, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে। কোনোভাবেই কোনো ধরনের ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। এতে চুক্তি নিয়ে বড় ধরনের জটিলতায় পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। চুক্তিতে পক্ষগণের নাম-ঠিকানা স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হলে এর ঠিকানা থাকতে হবে। চুক্তিতে কার কতটুকু অংশ বা ভূমিকা থাকবে, চুক্তি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা কাজ নিয়ে হলে তা শুরু ও অবসানের তারিখ, ব্যবসা–সংক্রান্ত হলে পুঁজি কত এবং এ থেকে কীভাবে লভ্যাংশ আদায় হবে, ব্যবসার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই চুক্তিতে থাকতে হবে। কেউ যদি কোনো জমি বিক্রয় করতে চান, তাহলে জমি বাবদ সমমূল্যের কিছু অংশ ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করে প্রাথমিক পর্যায়ে বায়নাপত্র করে নিতে হয়। এটাও একধরনের চুক্তিনামা। এ দলিলই ক্রেতার মালিকানা প্রমাণ করে। বায়নানামা সম্পাদন করলে তা অবশ্যই সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। ডেভেলপারের সঙ্গে চুক্তিও রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক।
চুক্তিতে কোনো বিরোধ দেখা দিলে কীভাবে নিষ্পত্তি হবে, তা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। বিশেষ করে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আলোচনা কিংবা সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার সুযোগ থাকবে কি না, তা অবশ্যই উল্লেখ থাকা দরকার। বর্তমানে সব ক্ষেত্রে মীমাংসার মাধ্যমে যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই চুক্তিপত্রের একটি অনুচ্ছেদে এ–সংক্রান্ত শর্ত রাখা জরুরি। চুক্তিনামায় সালিস আইন ২০০১–এর মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিধান রাখা যেতে পারে। যেকোনো চুক্তিপত্রের শেষের অংশে দুই পক্ষের স্বাক্ষর এবং সাক্ষীদের স্বাক্ষর থাকতে হবে। যে তারিখে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সে তারিখ চুক্তিপত্রে দিতে হবে। সাধারণত চুক্তিপত্র করতে হয় ৩০০ টাকার নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে তার তারতম্য হতে পারে। যেমন অংশীদারি ব্যবসায়িক চুক্তিপত্র চুক্তি করতে হয় চার হাজার টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে। তবে ব্যবসার মূলধন এক লাখ টাকা পর্যন্ত হলে দুই হাজার টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি করলেই চলবে। সাধারণ চুক্তিপত্র নোটারি পাবলিক বা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে নোটারাইজড করতে হবে। অংশীদারি চুক্তির ক্ষেত্রে ‘রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিস’ থেকে নিবন্ধন করাতে হবে।
চুক্তি ভঙ্গের প্রতিকার
কেউ চুক্তিনামা অনুযায়ী কাজ না করলে বা শর্ত ভঙ্গ করলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি দুভাবেই প্রতিকার চাওয়া যায়। তবে যেসব চুক্তির মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের বিষয় জড়িত থাকে, সে ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতে আশ্রয় নিতে হয়। বায়নাপত্রের চুক্তি মোতাবেক দলিল সম্পন্ন করতে কোনো পক্ষ অস্বীকার করলে বা টালবাহানা করলে এর বিরুদ্ধে দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। এ ধরনের প্রতিকার দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা এবং এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দলিল সম্পাদনের জন্য বাধ্য করা যায়। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
অংশীদারদের মধ্যে কোনো চুক্তি ভঙ্গ হলেও দেওয়ানি আদালতে যেতে হবে। টাকা লোন নিয়ে পরিশোধ না করলে এবং এ–সংক্রান্ত চুক্তি থাকলে প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আনা যায়। দেওয়ানি আদালতে টাকা আদায়ের জন্যও মোকদ্দমার সুযোগ আছে।
চুক্তিতে কোনো নির্দিষ্ট শর্ত থাকলে এবং তা প্রতিপালন না করলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন অনুযায়ী দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নেওয়া যায়, চাওয়া যায় ক্ষতিপূরণ। আদালতে বিভিন্ন প্রকারের নিষেধাজ্ঞার আবেদনও করা যায়। তবে কোনো চুক্তিতে আপস–মীমাংসা, সালিস এসবের বিধান থাকলে অবশ্যই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে সালিস আইন ২০০১–এর বিধান থাকলে সালিস ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে। চুক্তিনামায় এ বিধান থাকলে তা প্রতিপালন না করে দেওয়ানি আদালতে গেলে আদালত মোকদ্দমা খারিজ কিংবা স্থগিত রাখার আদেশ দিতে পারেন।
তানজিম আল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী