আসল নায়কের অনুসন্ধানে

ভাষা আন্দোলনের ঘটনা নানাভাবে উদ্দীপ্ত করেছে মানুষকে। এর গভীর প্রভাব পড়েছে পরবর্তী ইতিহাসে। এই আন্দোলনের আবেগ স্ফুরিত হয়েছে সাহিত্যে, গানে, চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে। কবিতা ও কথাসাহিত্য থেকে গবেষণা পর্যন্ত পৌঁছেছে এর প্রেরণা। এখানে রইল ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত একটি বইয়ের আলোচনা।

ভাষা আন্দোলনের সত্যিকারের নায়ক কে? বামপন্থী রাজনীতিক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর তাঁর পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইয়ের উৎসর্গপত্রে কোনো ব্যক্তি বা কোনো সংগঠনকে নয়, পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণকে ভাষা আন্দোলনের সত্যিকারের নায়ক বলে চিহ্নিত করেছেন।

১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের প্রথম পর্বের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তথ্যানুসন্ধানের সূত্রে তাঁর উপলব্ধিতে আসে, ভাষা আন্দোলন আমাদের ইতিহাসের মহামূল্যবান এক সম্পদ। প্রথমে তিনি এক আত্মীয়ের পরামর্শে আলাদা করে ভাষা আন্দোলনের ওপর এক শ পৃষ্ঠার একখানা বই লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ক্যানভ্যাস ও গুরুত্ব এতটাই বিশাল যে শেষ পর্যন্ত ৩ খণ্ডে প্রায় ১ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার বিশালাকার গবেষণা বই (বাতিঘর সংস্করণ) তাঁকে লিখতে হয়েছে।

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও
তৎকালীন রাজনীতি

বদরুদ্দীন উমর

মাওলা ব্রাদার্স, প্রথম প্রকাশ: ১৯৭০

পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইটি প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের আকর গ্রন্থ। ভাষা আন্দোলন নিয়ে এ পর্যন্ত যত বই লেখা, তার বেশির ভাগই স্মৃতিকথা কিংবা ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু বদরুদ্দীন উমর এই বইয়ে অর্থনীতি, সমাজনীতি, নানা রাজনৈতিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি, প্রতিরোধ আন্দোলন, কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা, সিভিল সার্ভিস বা আমলাতন্ত্রের ভূমিকার অনুসন্ধান তুলে ধরেছেন।

বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন আর ১৯৫১–৫২ সালের ভাষা আন্দোলন—এ দুই পর্বের আন্দোলনের মধ্যে ‘সচেতনতা, ব্যাপকতা, সাংগঠনিক তৎপরতার ক্ষেত্রে তারতম্য এত বেশি যে প্রথম দৃষ্টিতে এই তারতম্যকে মনে হয় গুণগত।’ মাত্র চার বছরের ব্যবধানে তৎকালীন পূর্ব বাংলার সামাজিক–রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তনের কারণ খুঁজেছেন বইটিতে। কেননা, প্রথম পর্বের আন্দোলনের সময় ছাত্ররা গুলিস্তানের রেললাইন পার হলে পুরান ঢাকার মানুষদের মারপিটের শিকার হতেন। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে সেই পুরান ঢাকার লোকেরাই ছিলেন প্রধান শক্তি। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলির ঘটনায় তিন–চার দিনের জন্য ঢাকায় যে অভ্যুত্থান–পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে পুরান ঢাকার লোকেরা ছিলেন বড় নিয়ামক।

বদরুদ্দীন উমর দেখিয়েছেন, ভাষা আন্দোলন ছাত্র-শিক্ষকেরা শুরু করলেও সেটা সমগ্র জনগণের আন্দোলন হয়ে উঠেছিল। এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘অনেকের ধারণা, ভাষার ব্যাপারটা শিক্ষিত লোকেদের বিষয়। কিন্তু ভাষাটা শিক্ষিত লোকের চেয়ে গরিবদের অনেক বেশি দরকার।’

বদরুদ্দীন উমর ঢাকার ভাষা আন্দোলন কীভাবে মফস্​সল ও গ্রামাঞ্চলের কৃষক এবং সাধারণ মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের মজুরেরা ঢাকায় গুলি এবং ছাত্রদের নিহত হওয়ার খবর শুনে কীভাবে নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট ডেকেছিলেন, সে উদাহরণ তিনি তুলে এনেছেন। ভাষা আন্দোলনের এই ব্যাপকতার পেছনে খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষের প্রভাব কী ছিল, তারও অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তিনি।

তেভাগা, নানকার, টঙ্ক প্রথাবিরোধী কৃষক আন্দোলনসহ অন্যান্য আন্দোলন এবং নিষ্ঠুরভাবে এসব আন্দোলন দমন কীভাবে পূর্ব বাংলার সমাজ–রাজনীতির রূপান্তর এবং সোনার পাকিস্তানের প্রতি মানুষের মোহ ভঙ্গ করেছিল, বলা চলে তার অনুসন্ধানই এই বই। ছাত্ররা তখনো কৃষক কিংবা তাঁদের গা থেকে কৃষকের গন্ধ মুছে যায়নি। এই শ্রেণি ঐক্যই ঢাকার ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলনের সঙ্গে সারা দেশের সাধারণ মানুষের যোগসূত্র গড়ে দিয়েছিল।

বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে দেখেছেন পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক জাগরণের বৃহত্তর পটভূমিকায়। ষাটের দশকে প্রকাশিত পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইটি ইতিহাসের নিষ্ঠাবান পাঠক ও গবেষকদের অজস্র চিন্তার জোগান দিয়েছে। তা শুধু উপাদানের দিক থেকেই নয়, পদ্ধতির দিক থেকেও। ভবিষ্যতের পাঠক ও গবেষকদের ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রেও বইটি মাইলস্টোন হিসেবে থেকে যাবে।

লেখক: লেখক ও সাংবাদিক।