চিম্বুক পাহাড়ে বর্ণমালার ঘর
বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়। মেঘছোঁয়া এই পাহাড়ের ক্রামাদিপাড়ায় তৈরি হয়েছে একটি অন্য রকম স্থাপনা। নাম বর্ণমালার ঘর। এই বর্ণমালার ঘর ম্রো সম্প্রদায়ের। সেখানে সাজানো রয়েছে ম্রো বর্ণমালা। ভাষাটি যাতে হারিয়ে না যায়, যেন বাসিন্দারা এসে তাদের মুখের ভাষার লিখিত রূপটি শিখতে পারেন, সে জন্য এমন ব্যবস্থা।
গতকাল শনিবার ছিল ম্রো বর্ণমালার আত্মপ্রকাশের দিন। দিনটি স্মরণীয় করে রেখে ম্রো ভাষা ও ক্রামা ধর্মের (ম্রো জনগোষ্ঠীর ধর্ম) প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে বর্ণমালা ঘর করা হয়েছে। গতকাল বর্ণমালা ঘরটি উদ্বোধন করেন ক্রামা ধর্মের প্রধান পুরোহিত মাংইয়া ম্রো।
ম্রো জনগোষ্ঠীর ক্রামা ধর্মের ৪০তম বার্ষিক ধর্মীয় সম্মেলনও গতকালই শুরু হয়েছে। দুদিনের এই সম্মেলনের শুরুতে বর্ণমালা ঘর উদ্বোধন করা হয়। নিজেদের ভাষা ও বর্ণমালার টানে শত শত ম্রো ভাষার নারী-পুরুষ দূরদূরান্ত থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছেন। তাঁদের সবারই একই কথা, বর্ণমালা হলো ভাষা রক্ষার অন্যতম উপাদান। আর ভাষা রক্ষা হলেই সমাজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য-প্রথা, মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে। এই উপলব্ধি থেকে নিজেদের উদ্যোগে ও টাকায় বর্ণমালা ঘর করেছেন তাঁরা।
বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ক্রামাদিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাড়া থেকে প্রায় ২০০ মিটার দক্ষিণে আধা পাকা ছোট্ট বর্ণমালা ঘর। সবুজ বনবেষ্টিত মনোরম পাহাড়ের একটি পাথরে বসে ধর্মীয় গুরু মেনলে ম্রো ‘ক্রামা ধর্ম’ প্রবর্তনের আগে ধ্যান করেছিলেন। ওই ধ্যানের পাথরের পাশে একটি পাকুড় ও বটগাছ রয়েছে। বটগাছের ছায়ায় ঘেরা বর্ণমালার ঘরে সারি সারি ম্রো বর্ণমালা সাজানো। একটি কাঠের বইয়ে কয়েকটি হরফ খোদাই করা হয়েছে। প্রকৃতি–ঘনিষ্ঠ সরল জীবনের ম্রোদের বর্ণমালা ঘরটির আয়োজনও সরল প্রকৃতির মতোই অনাড়ম্বর।
ম্রো বর্ণমালা বা হরফ অনেকটা রোমান ধাঁচের। এতে কিছুটা বর্মি ও মোনখেমার বর্ণমালার সংমিশ্রণ রয়েছে। বর্ণমালা উদ্ভাবক মেনলে ম্রোর ভাই কিরওয়ান ম্রো জানালেন, মোট ৩১টি হরফের মধ্যে ছয়টি স্বরবর্ণ। রোমান বর্ণমালার বড় ও ছোট হাতের বর্ণের মতো ম্রো বর্ণমালায়ও সাংলু, ইউকলুং ও মুক্লুং—তিন ধরনের বর্ণ রয়েছে। আবার ধর্মের জন্য শুধু ইউক্লুং বর্ণ ব্যবহার করা হয়।
ক্রামাদিপাড়ায় ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে ক্রামাদি (ধর্মীয় গুরু) মেনলে ম্রো বর্ণমালার আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এ জন্য ডিসেম্বরে বর্ণমালা ঘর স্থাপন করা হয়েছে। ঘরটির নাম দেওয়া হয়েছে থারকিম। যার অর্থ ফুলের কলি থেকে ফোটা ফুল। ম্রো সমাজের শিক্ষিত একজন পাকো ম্রো। তিনি জানালেন, ১৯৮২ সাল প্রবর্তিত এই নতুন ধর্ম ভাষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় ম্রো সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ম্রো নবীনতম এই ক্রামা ধর্মের অনুসারী এবং প্রায় ৮০ শতাংশ ম্রো এই বর্ণমালায় লেখতে-পড়তে পারেন। ২০২১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী ম্রোদের জনসংখ্যা ৫১ হাজার ৪৪৮। ম্রোরা শুধু বান্দরবান পার্বত্য জেলার সাতটি উপজেলায় বসবাস করে।
ক্রামা ধর্মের প্রধান পুরোহিত মাংইয়া ম্রো বললেন, মূলত ক্রামাদি মেনলে ক্রামা ধর্মের ধর্মীয় বিধিবিধান সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য ক্রামা বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছিলেন। ধর্মীয় বর্ণমালাটি এখন ম্রো বর্ণমালা হয়েছে। এই বর্ণমালার উন্নয়ন ও ব্যবহারিক ক্ষেত্র বাড়াতে বর্ণমালা ঘর ভূমিকা রাখবে। এটি সামাজিক উদ্যোগ এবং ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছে। তবে তাদের ভাষা উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতা সবচেয়ে জরুরি।