জনপ্রশাসন সংস্কার চাইলে প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষমতা কমাতে হবে
পদোন্নতি, পদায়ন, গাড়িসুবিধা, বিদেশ সফর—সবকিছুর একক ক্ষমতা প্রশাসন ক্যাডারের হাতে। সচিব ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) ক্ষমতাও অবারিত। জনপ্রশাসনে সংস্কার করতে চাইলে প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষমতা কমাতে হবে। একই সঙ্গে জনসেবার বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে।
আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ভয়েস ফর রিফর্ম আয়োজিত এক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।
‘জনহয়রানি থেকে জনকল্যাণ: কীভাবে হতে পারে প্রশাসনের মৌলিক সংস্কার’ শিরোনামের এ সংলাপে বক্তব্য দেন সাবেক সচিব সৈয়দ সুজাউদ্দিন আহমেদ, আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক সৈয়দ মাহবুবুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আসিফ শাহান ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
অধ্যাপক আসিফ শাহান বলেন, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভুটানের মতো দেশে প্রশাসনের একটা পেশাদারত্বের মূল্য (ভ্যালু) রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এই কাঠামো গড়ে ওঠেনি। এমনও দেখা গেছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সচিবেরা উপস্থিত না থেকে তাঁর একজন প্রতিনিধি পাঠান। এটা উচিত নয়।
প্রশাসন ক্যাডার সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী উল্লেখ করে অধ্যাপক আসিফ বলেন, সংস্কার খুব কঠিন শব্দ। বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। প্রশাসনের ক্ষমতা কমাতে হলে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদের জন্য কোটাপদ্ধতি বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে।
উল্লেখ্য, উপসচিব থেকে ওপরের পদগুলোতে ৭৫ শতাংশ পদোন্নতি হয় প্রশাসন ক্যাডার থেকে এবং ২৫ শতাংশ পদোন্নতি হয় অন্যান্য ক্যাডার ছেড়ে আসা কর্মকর্তাদের।
জনপ্রশাসনে সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরে এই শিক্ষক বলেন, না হলে আমলারা বারবার বলেই যাবেন, তাঁরা রাজনৈতিক দলের নির্দেশ পালন করেছেন। নিজেদের দায়ভার কখনো স্বীকার করবেন না।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা চেয়ারম্যান পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ না দিয়ে সেখানে ওই সংস্থার নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিয়ে সরকারি দপ্তর ভালো চলে না। সরকার চাইলে বেসরকারি খাত থেকেও আনতে পারে। সরকারের বিভিন্ন কমিশনেও সাবেক আমলাদের নিয়োগ না দিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কিংবা বেসরকারি খাত থেকে কাউকে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা বলেন, জনসেবা করতে হলে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। দেখা যাচ্ছে, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কারে স্ব স্ব ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তাদের দিয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে। এতে খুব একটা কাজ হবে না বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কীভাবে সংস্কার হয়, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কোথাও কোনো কাজ হচ্ছে না উল্লেখ করে গোলাম মোর্তোজা বলেন, আগে টাকা নিয়ে কাজ করত। এখন টাকা নিতে পারছে না। অন্তর্বর্তী সরকার যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করেন তিনি।
আন্তক্যাডার বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দেন সৈয়দ সুজাউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সেবা নিতে গিয়ে জনগণের ভোগান্তির কারণ হলো জবাবদিহি নেই। একজন কর্মকর্তার দায়িত্ব কী, সেবা দিতে দেরি করলে এর জন্য দায়ী কে, তা আইনে সুস্পষ্টভাবে থাকতে হবে।
ক্যাডারভিত্তিক বৈষম্যের কথা তুলে ধরে সৈয়দ সুজাউদ্দিন আহমেদ বলেন, উপসচিবেরা গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে ঋণ পান। আবার সে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি মাসে টাকাও পান। অথচ অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ সুবিধা পান না। এ বৈষম্য বন্ধ করতে হবে। হয় সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এ সুবিধা দিতে হবে, নয়তো এ সুবিধা বাদ দিতে হবে।