অলাভজনক ও অপচয়ের ৩০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন নেন সাবেক মন্ত্রী-সচিব-রাজনীতিবিদেরা

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একসময়ের একান্ত সচিব (পিএস) ছিলেন সাজ্জাদুল হাসান। ২০১৫ সাল থেকে তিন বছর ছিলেন এ পদে। সে সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাপ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে নিজ জেলা নেত্রকোনায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন নেন সাজ্জাদুল।

পিএস থেকে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব হয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেন। ওই বছর শেখ হাসিনা ময়মনসিংহ সফরে গিয়ে ‘নেত্রকোনা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’–এর ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন। অনুমোদন নেওয়ার পর ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও অর্থনৈতিক অঞ্চলটির কোনো কাজই হয়নি।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কর্মকর্তারা বলছেন, নেত্রকোনায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আর্থিকভাবে কখনো লাভজনক হবে না। কেননা, সেখানকার যোগাযোগব্যবস্থা ভালো নয় এবং বড় বিনিয়োগকারী সেখানে যাবে না। সরকার বিনিয়োগ করলে সে টাকাও অপচয় হবে। তাদের সমীক্ষায় বিষয়টি উঠে এসেছে। অথচ চাপে পড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলটির অনুমোদন দিতে হয়েছিল।

বেজার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নেত্রকোনার অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো এসব অঞ্চলও জাতীয় পর্যায়ে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, হবে না লাভজনক; বরং সেখানে বিনিয়োগ করলে অর্থের অপচয় হবে। এরই মধ্যে অঞ্চলগুলোয় সমীক্ষাসহ অন্যান্য খাতে টাকা খরচ হয়েছে। এখন এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিল করা উচিত।

সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেত্রকোনা-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাজ্জাদুল হাসান। তবে গত ৫ আগস্টের আগে তিনি দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটির বিষয়ে জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।  

সাজ্জাদুল হাসানের মতো চাপ প্রয়োগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে গত ১৫ বছরে (আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে) নিজ নির্বাচনী এলাকায় এমন অন্তত ৩০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন করিয়ে নেন সাবেক মন্ত্রী থেকে শুরু করে সচিব, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

বেজার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নেত্রকোনার অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো এসব অঞ্চলও জাতীয় পর্যায়ে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, হবে না লাভজনক; বরং সেখানে বিনিয়োগ করলে অর্থের অপচয় হবে। এরই মধ্যে অঞ্চলগুলোয় সমীক্ষাসহ অন্যান্য খাতে টাকা খরচ হয়েছে। এখন এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিল করা উচিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেজার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অনুমোদন নেওয়া এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিটির সমীক্ষায় তাদের খরচ হয়েছে গড়ে ২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ৩০ প্রকল্পের সমীক্ষায় খরচ হয় ৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের সময় নষ্ট হয়েছে। এর পেছনে সময় না দিয়ে যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল ভালো করছে, সেখানে সময় দিলে ভালো হতো।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম মেয়াদে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। তখন বলা হয়, অঞ্চলগুলোয় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে, সেখান থেকে চার হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থের পণ্য রপ্তানি হবে। পরের বছর, অর্থাৎ ২০১০ সালে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও পরিচালনায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)’।

২০৩০ সালের মধ্যে ওই ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবে বেজার শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠিকমতো করতে পারলে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলই যথেষ্ট। কৃষিজমি নষ্ট করে ১০০টি করার প্রয়োজন নেই।’

সংস্থাটির দেওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, তৎকালীন সরকার গভর্নিং বোর্ডের সভায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ১০৪টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে সরকারি ৬৮টি, বেসরকারি ৩৪টি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশে এখন ২৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ চলছে। অবশ্য এ পর্যন্ত দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে শুধু চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, নারায়ণগঞ্জে জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল।

সালমান এফ রহমানের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ২০১৯ সালে তাঁর নির্বাচনী এলাকা নবাবগঞ্জে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন করিয়ে নেন। অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে ১ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয় একটি প্রকল্প, যার পুরোটাই সরকারি তহবিল থেকে। প্রকল্পের আওতায় ৮৮১ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা বাবদ ব্যয় ধরা হয় ৫৭৫ কোটি টাকা।

এ–সংক্রান্ত নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নবাবগঞ্জে যেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি ঠিক করা হয়েছে, সেখানে মৌজা রেটের তুলনায় বাজারমূল্য অনেক বেশি। কৌশলে সেখানে মৌজা মূল্য কম রাখা হয়েছে।

বেজা সূত্রে জানা গেছে, ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলটি না করতে শুরু থেকে বিপক্ষে অবস্থান নেন বেজার কর্মকর্তারা। তাঁদের যুক্তি ছিল, ওই এলাকায় জমির দাম বেশি; খাসজমি তেমন নেই। তাঁদের হিসাবে, শুধু জমি অধিগ্রহণেই আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। বিপুল টাকা বিনিয়োগ করে জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল করলে লাভজনক হবে না। তবে কোনো যুক্তির ধার ধারেননি সালমান এফ রহমান।

অবশ্য প্রকল্পটি একনেকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন পাওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। কারাগারে থাকায় এ বিষয়ে সালমান এফ রহমানের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

‘শেখ হাসিনাকে খুশি করতে দুই অর্থনৈতিক অঞ্চল’

গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া ও সদর উপজেলায় একটি করে অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দেয় তৎকালীন সরকার। এর মধ্যে কোটালিপাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ৪৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয় একটি প্রকল্প। বেজা কর্মকর্তারা বলছেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করতেই এ দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা নেওয়া হয়; যদিও এ দুটি জায়গায় এ অঞ্চল করার প্রয়োজন ছিল না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন এ দুটি অঞ্চলের প্রস্তাব বাতিল করা হতে পারে।

প্রকল্প বাগিয়ে নেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী রাজ্জাক, সংসদ সদস্য নাঈমুর ও ব্যবসায়ী এস আলম

সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক তাঁর নির্বাচনী আসন টাঙ্গাইলে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন নেন। সাবেক সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান (দুর্জয়) তাঁর নির্বাচনী আসন মানিকগঞ্জে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন নেন। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাগিয়ে নেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম।

বেজা বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রস্তাব বাতিল হতে পারে। এ ছাড়া, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে বাতিল হতে পারে বরিশাল, কক্সবাজারের মহেশখালী, ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, নাটোরের লালপুর, বাগেরহাটের সুন্দরবন, খাগড়াছড়ির আলুটিলা, নওগাঁর সাপাহার, সুনামগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ ও মাদারীপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল।

অন্যদিকে বেসরকারিভাবে বাতিলযোগ্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে, ছাতক অর্থনৈতিক অঞ্চল, গার্মেন্টস শিল্প পার্ক বিজিএমইএ, ফমকম অর্থনৈতিক অঞ্চল, অ্যালায়েন্স অর্থনৈতিক অঞ্চল, ইস্ট কোস্ট গ্রুপ অর্থনৈতিক অঞ্চল, সিটি স্পেশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল ও মডার্ন স্পেশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল।

শিকদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হচ্ছে

এদিকে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে তিনটি শিল্প গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত এসবিজির (শিকদার, বসুন্ধরা ও গ্যাসমেন গ্রুপ) সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ তিন গ্রুপকে ৫০০ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বেজার সঙ্গে এসবিজি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৫০ বছরের চুক্তি হয়।

প্রকল্পে বেজা জমি হস্তান্তর করলেও এখনো ৮৫ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। তিন প্রতিষ্ঠানের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) পদ্ধতিতে সেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন করার কথা। বাস্তবে তারা সেখানে কোনো কাজ করেনি। জমি নিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী, তিন বছরের মধ্যে অনসাইট অবকাঠামো উন্নয়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কোনো অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করা হয়নি। এখন ওই চুক্তির অবসান করতে যাচ্ছে বেজা।

বেজা কর্তৃপক্ষ ও বিশিষ্টজনের বক্তব্য

৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বেজার নতুন নির্বাহী চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয় আশিক চৌধুরীকে। বেজার কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের আবেদন নেই, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না, সেগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যানকে দেওয়া হবে।

আশিক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, একই সময়ে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া সব অর্থনৈতিক অঞ্চল লাভজনক হবে না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব অনুযায়ী তিনি অগ্রাধিকারের তালিকা করবেন। অনুমোদিত সব অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে তিনি একটি বিশ্লেষণ করবেন। তাতে যেসব অঞ্চল লাভজনক হবে না, বিনিয়োগকারী যাবে না, সেগুলো পুনর্বিবেচনা করা হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিল্পায়নের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল দরকার আছে। কিন্তু এমন অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হচ্ছে, যেগুলো চাপ প্রয়োগ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নেওয়া হয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখবে না, লাভজনকও হবে না।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ এসেছে অর্থনৈতিক অঞ্চলের অগ্রাধিকার ঠিক করা। যেসব অঞ্চলের কোনো আবেদন নেই, সেসব বাতিল করা।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন