চা–শ্রমিকদের ‘তলব বাজার’
আনন্দে থাকলে মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। চা–বাগানের নারী চা–শ্রমিকের অপুষ্ট শরীর, মলিন পরিধান আর ক্লান্তির ছাপ উধাও হয়ে যায় সপ্তাহের একটি দিন এক বেলার জন্য। এটি ঘটে তলববারে তলব বাজারে। সিলেট অঞ্চলে অধিকাংশ চা–বাগানে দিনটি হয় বুধবারে। সপ্তাহের যে দিনটি তাঁদের মজুরি দেওয়া হয়, সেদিনকে বলে তলববার। এর সঙ্গে মিল রেখে একই দিনে বসা অস্থায়ী বাজারের নাম তলব বাজার।
তবে অঞ্চলভেদে এর নাম বাগান বাজারও বলা হয়। সাধারণত হাঁটাদূরত্বে বাগানের পাশের কোনো জায়গায় বসে এই বাজার। যেমন শ্রীমঙ্গলের ইস্পাহানি কোম্পানির জেরিন টি গার্ডেনে তলব বাজার বসে এখানকার গোবিন্দপুরের নাটমন্দির ঘিরে। ভাড়াউড়া চা–বাগানের তলব বাজার বসে বাগানের সর্বজনীন দুর্গামন্দিরের মাঠে। পান–সুপারি থেকে শুরু করে শাকসবজি অথবা কাচের বাক্সে নিকেল করা স্বর্ণাভ গয়না পাওয়া যায় এ বাজারে। ১০-২০ টাকার এক জোড়া কানের দুল নিজের কন্যাসন্তানটির জন্য কিনে নেন নারী চা–শ্রমিক। এ বাজারে পাহাড়ি নদীর মাছ থেকে শুরু করে পাওয়া যায় হাতে বানানো তেলেভাজা পিঠা পর্যন্ত। আয় যত কমই হোক, নারী চা–শ্রমিকেরা সপ্তাহের এই একটি দিন মজুরির টাকা পেয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য সবটুকু স্নেহ উজাড় করে দিতে চান এটা-সেটা কিনে। বেশি ভিড় থাকে পোশাকের দোকানে। অল্প দামে সুন্দর সুন্দর পোশাক নিয়ে আসেন বিক্রেতারা।
গত ১৫ নভেম্বর ছিল বুধবার। শ্রীমঙ্গলের গোবিন্দপুরে তলব বাজারের মাঝখানে উঁচু বাঁধানো জায়গাটি দেখিয়ে অনিলা রাতি জানালেন, এখানে একসময় তাঁরা যাত্রাপালা দেখেছেন। তাঁর নিজের বিশেষ কিছু কেনার ছিল না, তবু কিছু শাকপাতা নিলেন। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে উঁচু সে জায়গাকে কেন্দ্র করে বসা পোশাকের তিনটি দোকানে। পুঁতি বসানো, জরির কাজ করা একটু বেগুনি রঙের জামার গায়ে দামি ব্র্যান্ডের ট্যাগ লাগানো ছিল। ওটাই বারবার নেড়েচেড়ে শেষে ৩০ টাকায় নিয়ে নিলেন চা–শ্রমিক নীলাঞ্জনা পানিকার। বললেন, কদিন আগেই কালীপূজা গেছে। একটু খরচাপাতি হয়েছে। তবু জামাটা নিলেন নিজের ১২ বছর বয়সী মেয়ের জন্য।
তলব বাজারের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা সবাই ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। এই দিনে তলব বাজারে বিক্রিবাট্টা ভালো হয় বলে তাঁরা বুধবার পসরা নিয়ে আসেন। শ্রীমঙ্গলসহ সিলেটের অধিকাংশ চা–বাগানের তলববার বুধবার। তবে রোববার চা–শ্রমিকদের ছুটির দিন বাদে অন্য দিনও হতে পারে দিনটি। মৌলভীবাজার, সিলেট এবং চট্টগ্রামের মোট সাতটি বাগানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সব বাগানেই বসে অস্থায়ী এই তলব বাজার। প্রচলনটি ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম চা–বাগান তৈরির সময় থেকেই হয়ে আসছে।
চট্টগ্রামের একটি বিখ্যাত চা–বাগানের সঙ্গে চার দশক ধরে থাকা একজন মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নাম ধরে ডেকে ডেকে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় বলেই ‘তলব’ শব্দটি ব্যবহার হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে চা–বাগান তৈরির সময় থেকে এ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তখন বাজার বসত বাগানের নিয়ন্ত্রণে। ধীরে ধীরে সে ব্যবস্থা বদলেছে।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ধামাই চা–বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. দবিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বাগানের চা–শ্রমিক অরুণ, সীতেশ বলছিল তাদের বহু প্রজন্ম ধরে জেনে এসেছে চা–বাগানে তলব বাজার বসে। এটা ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু হচ্ছে।’ অর্থাৎ চা–বাগান ঘিরে চা–শ্রমিকদের জন্য এই বাজার বসার প্রচলনের বয়স প্রায় পৌনে দুই শ বছরের।
বাগান থেকে পাতা তোলা শেষ করে, ওজন দিয়ে সাধারণত বাড়ি চলে যান শ্রমিকেরা। পরিচ্ছন্ন হয়ে পোশাক বদলে আসেন মজুরি নিতে। দিনে অন্তত ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয় শ্রমিকদের। ২৩ কেজিতে হয় এক নিরিখ। এর বেশি তুললে এর জন্য ওজন হিসেবে কিছু বাড়তি পয়সা জোটে তাঁদের। সপ্তাহান্তে প্রায় বারো শ থেকে দেড় হাজার টাকা হাতে পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিজেই নিজের অধিপতি হয়ে যান এই চা–শ্রমিকেরা।
সেদিন (১৫ নভেম্বর) শ্রীমঙ্গলের গোবিন্দপুরের তলব বাজার থেকে ফেরার পথে চা–বাগানের মধ্যে সন্ধ্যা নামল। বিরোহিনী হাজরা তখন বাড়ির পথ ধরেছেন। হাতের প্যাকেটের বস্তুটি কী, জানতে চাইলে একটু লজ্জা পেয়ে দেখালেন তিনি এক বোতল আলতা কিনেছেন। নিজেই বললেন, মেয়ের জন্য কিনেছেন। দিনমান রোদে পুড়ে তেতে থাকা মুখেও তখন দেখা মিলল একটু আনন্দের রঙিন আভা। আলতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় সে আনন্দের রংটুকু।