বাধা পেরিয়ে ‘অদ্বিতীয়া’ তাঁরা
মৌলভীবাজারের একটি চা–বাগানের শ্রমিক গোলাপ কৈরী। মজুরি পান মাত্র ১২০ টাকা। স্বল্প মজুরিতে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে।
ছেলেমেয়েদের পড়ানো তাই তাঁর কাছে রীতিমতো দুঃসাধ্য। আর্থিক সংগতি না থাকায় বন্ধ হয়ে যায় বড় তিন সন্তানের পড়াশোনা। একই কারণে থেমে যাচ্ছিল মেয়ে শিল্পী কৈরীরও শিক্ষাজীবন। তবে দারিদ্র্যের কাছে হার মানেননি শিল্পী। সব বাধা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়—এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) ২০২১ সালে স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন তিনি।
এখানেই লড়াই শেষ হয়নি শিল্পীর। ভর্তি হলেও শঙ্কা ছিল পড়ার খরচ নিয়ে। তখন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্ট। পেয়েছেন ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি। শিক্ষাজীবন শেষে নিজের সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কাজ করার স্বপ্ন দেখছেন নবীন এই শিক্ষার্থী।
শিল্পী কৈরীসহ ১০ ছাত্রী এবার পেয়েছেন আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি। তাঁরা কেউ উঠে এসেছেন চা–বাগান থেকে, কেউ পাহাড়ের দুর্গম গ্রাম থেকে। আবার কেউ এসেছেন দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। তাঁদের সবার গল্পই একই। দারিদ্র্য তাঁদের পরিবারের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তা জয় করে তাঁরা উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছেন। এই ১০ অদ্বিতীয়াকে আজ সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের এম এম আলী সড়কে অবস্থিত এইউডব্লিউর মিলনায়তনে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের বাবা চা–শ্রমিক, দুজনের বাবা কৃষক, দুজনের বাবা নেই ও আরেকজনের বাবা কর্মহীন।
২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত বৃত্তি পেয়েছেন ৮৮ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে স্নাতক শেষ করেছেন ৪৮ জন।
২. এমফিল, পিএইচডিসহ উচ্চতর শিক্ষার জন্য কানাডা, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন অন্তত আট শিক্ষার্থী।
অনুষ্ঠানে শিল্পী কৈরী যখন বাধা জয় করার গল্প বলছিলেন, তখন মুগ্ধ চিত্তে তাঁর কথা শুনছিলেন অতিথিরা। শিল্পী ছাড়াও অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা জয় করার গল্প শোনান বৃত্তি পাওয়া আরও তিন ছাত্রী। বৃত্তি পাওয়া সবাই পরিবারের প্রথম নারী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাই পরিবার ও সমাজের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতে চান নিজেদের।
প্রথম আলো ট্রাস্ট ২০১২ সাল থেকে এ বৃত্তি দিয়ে আসছে। ট্রান্সকমের সহযোগিতায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত বৃত্তির কার্যক্রম চলে। ২০১৭ সাল থেকে এ উদ্যোগে যুক্ত হয় আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড। বৃত্তির নতুন নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি। ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত বৃত্তি পেয়েছেন ৮৮ ছাত্রী। বৃত্তির আওতায় এএইউডব্লিউতে তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করা হয়।
দমাতে পারেনি দারিদ্র্য
শিল্পী কৈরীর মতো চা–শ্রমিক বাবার সন্তান রিংকি ভৌমিকও। জীবনের এ পর্যায়ে আসতে অনেক প্রতিবন্ধকতা পার হতে হয়েছে তাঁকে। অনুষ্ঠানে সেই দিনগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাবার মজুরি ছিল কম। তাঁর একার আয়েই চলে সংসার। তাই পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। তবে বাবা সব সময় সাহস ও উৎসাহ দিয়ে গেছে। তাই আমি হার মানি নাই।’ পড়ালেখা শেষে সমাজকর্মী হয়ে নিজের সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করতে চান বলে জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে কথা হয় বৃত্তি পাওয়া উম্যেচিং মারমার সঙ্গে। খাগড়াছড়ি সদরে বেড়ে ওঠা উম্যেচিংয়ের ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল বড় কিছু হওয়ার। উম্যেচিং জানালেন, তাঁর মা-বাবা কৃষক। জুমচাষ ও বাগান করেই চলে তাঁদের সংসার। তবে মা-বাবা কখনো তাঁদের টানাপোড়েন অনুভব করতে দেননি। সাধ্যমতো সবটুকু করেছেন। কিন্তু মা-বাবার কষ্ট ঠিকই তাঁর হৃদয়ে নাড়া দিত। এ কারণে বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর মধ্যে। এখন অদ্বিতীয়া বৃত্তি তাঁকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে। এখন বাবার কাছ থেকে আর টাকা নিতে হবে না। খরচ নিজেই চালাতে পারবেন। আর্থিক সংকট দূর হওয়ার কারণে পড়াশোনাতেও মনোযোগ দিতে পারবেন।
এ ছাড়া বৃত্তি পাওয়া অন্য সাত ছাত্রী হলেন ইশিতা গোয়ালা, রুনা আক্তার, রিপা সাধু, মুবাশ্বেরা ফেরদৌস, হেনা ত্রিপুরা, সোমাশ্রী চাকমা ও লিপি শীল।
অনুষ্ঠানে নতুন বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা যেমন ছিলেন, তেমনি অনুভূতি প্রকাশ করেন প্রাক্তন অদ্বিতীয়ারাও। ২০২০ সালে বৃত্তি পাওয়া ছাত্রী সোমা গোস্বামী বলেন, তাঁর বাবাও মৌলভীবাজারের একটি চা–বাগানের শ্রমিক। খুব অল্প বেতন পেতেন, যা দিয়ে পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ বহন করা ছিল দুঃসাধ্য। আর্থিক সংকটের কারণে পড়তে এসেও অনেক প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করতে হয়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। তবে এ বৃত্তি পাওয়ার কারণে সেসব সমস্যা দূর হয়েছে।
জীবন চলার পথে বাবার সাহস ও অনুপ্রেরণা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা সব সময় একটি কথা বলতেন, “এগিয়ে যাও। জীবন কঠিন। তবে লক্ষ্য পূরণ করা অসম্ভব নয়।” বাবার এসব কথা আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগাত।’
২০১৭ সালে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি পেয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেন জাহিদা আক্তার। বর্তমানে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। প্রথম আলো ট্রাস্ট ও আইডিএলসির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠান পাশে দাঁড়ানোতে পড়ালেখা শেষ করতে সক্ষম হয়েছেন। যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসেছিলাম, তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তাতে দমে যাইনি। নিজের লক্ষ্যে ছিলাম অবিচল। তাই সফল হয়েছি। এখন সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে, আমার অনুপ্রেরণায় এলাকার মেয়েরাও উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হয়েছেন। তাঁরা এখানে পড়তে আসছেন। এভাবে যদি প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করেও হলে “চেঞ্জ মেকার” পাওয়া যায়, তাহলে পরিবর্তন আসবে।’
২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত বৃত্তি পাওয়া ৮৮ ছাত্রীর মধ্যে ৪৮ জন স্নাতক শেষ করেছেন। অন্যরা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। এমফিল, পিএইচডিসহ উচ্চতর শিক্ষার জন্য কানাডা, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন অন্তত আট শিক্ষার্থী। আর অন্যদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে অধ্যয়নরত এবং চাকরি নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
‘অদ্বিতীয়ারা চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত’
অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রুবানা হক সংবর্ধনা পাওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা সবাই স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। স্বপ্ন দেখতে আমরা পছন্দ করি। স্বপ্নের হাত অনেক ওপরে। যত ওপরে হাত ওঠাবেন, তত ওপরে যেতে পারবেন। আজ বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দিলেন। আমরা তাঁদের উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি করেছি। এই ১০ অদ্বিতীয়া স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি। তাঁরা চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত।’
অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম জামাল উদ্দিন বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতের (সিএসআর) তহবিলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও প্রথম আলোর সঙ্গে ভালো ও কল্যাণমূলক কাজ করবেন তাঁরা। এইউডব্লিউর গবেষণাগার, গ্রন্থাগারসহ যেকোনো বিষয়ে সহায়তা করা হবে। বৃত্তি পাওয়া ছাত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জীবনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তোমরা সফল হলে সমাজ উপকৃত হবে।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান অদ্বিতীয়াদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের একজন বলে গেছেন, জীবন কঠিন। কিন্তু আমাদের সামনে যাওয়ার, যুদ্ধে যাওয়ার, লড়াই করার, বিজয়ের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মেয়েদের কথায় আমরা দারুণভাবে উৎসাহিত হলাম। অনুপ্রাণিত হলাম। তাঁদের ভেতরে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা ছিল বলেই তাঁরা এভাবে বলতে পেরেছেন। তাঁদের সহায়তা করতে হবে। এটাই বোধ হয় সবচেয়ে বড় কাজ।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, শিক্ষাবিদ সাফিয়া গাজী রহমান, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ, এইউডব্লিউয়ের ডিন বিনা খুরানা ও ডেভিড টেইলর, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক শায়লা শারমিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আদনান মান্নান, প্রকাশ দাশ গুপ্ত, সুবর্ণা মজুমদার ও সায়মা আলম, ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান সাঈদ আল নোমান, আবাসন প্রতিষ্ঠান সিপিডিএলের প্রেসিডেন্ট ইফতেখার হোসেন, ফ্যাশন ডিজাইনার রওশন আরা চৌধুরী, আইভি হাসান, শিল্পাদ্যেক্তা এইচ এম ইলিয়াছ, নূজহাত নূয়েরি, ফারজানা মালেক, সারিস্ট বিনতে নূর প্রমুখ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আল সাফা সাদিয়া ঐশ্বরী ও তুষ্টি মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন এইউডব্লিউর ভর্তিসংক্রান্ত পরিচালক রেহেনা আলম খান। অনুষ্ঠানে কবিতা, গান ও নৃত্য পরিবেশন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত দলের সদস্যরা। আলোচনাপর্ব শেষে বৃত্তি পাওয়া ছাত্রীদের হাতে সনদ তুলে দেন অতিথিরা।
২০০৮ সালে নারীশিক্ষার জন্য বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে এইউডব্লিউ। বর্তমানে সেখানে ১৯টি দেশের ১ হাজার ১০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন। পাস করে বের হয়েছেন ১ হাজার ২৭০ ছাত্রী। এখন ছয়টি বিভাগে পড়ানো হয়। বিভাগগুলো হলো কম্পিউটার সায়েন্স, বায়োইনফরমেট্রিকস, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, অর্থনীতি, রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনীতি এবং পাবলিক হেলথ।