স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি নির্বাচনে প্রয়োজন ‘টিউমার বোর্ড’ গঠন

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ২২ অক্টোবর।

অক্টোবর মাস বিশ্বব্যাপী স্তন ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতার মাস হিসেবে পালিত হয়। এ উপলক্ষে এসকেএফ অনকোলজি ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনার আয়োজন করে। পর্বটি ২২ অক্টোবর সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী ও সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েরা বানু শিউলী।

‘ক্যানসারকে আমরা অনেকেই “মডার্ন ডে ডিজিজ” বলে মনে করি। মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ক্যানসার বিষয়ে অবগত। বিশ্বব্যাপী স্তন ক্যানসার সবচেয়ে প্রচলিত ক্যানসারের মধ্যে একটি। এ কারণে স্তন ক্যানসার নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে। গবেষণার ফলে বের হয়েছে চিকিৎসাপদ্ধতি ও শনাক্তের কৌশল। প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা হলে স্তন ক্যানসার নিরাময়ের হার ৯৫ শতাংশের বেশি।’ এ রকম তথ্য দিয়েই আলোচনা শুরু করেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন।

স্তন ক্যানসার এবং এর ঝুঁকির বিষয়ে ডা. আলী আসগরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘কিছু ঝুঁকি আছে, যেগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যখন একজন নারীর বয়স ৫০ পার হবে, তখন তাঁর স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৩ শতাংশ থাকে। বয়স ৭০ হয়ে গেলে সেটা ৫ থেকে ৭ শতাংশ হয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, কোনো নারীর বংশের কারও স্তন ক্যানসার থাকলে তাঁরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কিন্তু কিছু ঝুঁকি এমন আছে, যেগুলো নিয়ন্ত্রণযোগ্য। যাঁদের বয়স ৫০-এর বেশি, তাঁরা তাঁদের ওজন কমিয়ে রাখলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়। এ ছাড়া ঝুঁকি কমানোর জন্য শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করার কথাও জানান তিনি।

স্তন ক্যানসারের লক্ষণগুলো দেখা গেলে কত সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. রাশেদুল হাসান বলেন, ‘কিছু সহজ লক্ষণ আছে, যেগুলো রোগীরা নিজেরাই পরীক্ষা করতে পারবেন। যেমন রোগী যদি তাঁর স্তনে বা বগলে চাকা অনুভব করতে পারেন, স্তন থেকে তরল কিছু নিঃসরিত হয়, স্তনের চামড়ার কোনো পরিবর্তন যদি দেখতে পান, আকারের যদি কোনো পরিবর্তন হয়, সেটাকে আমরা স্তন ক্যানসারের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করি।’

‘জেনেটিক ইতিহাস’ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। এই জেনেটিক ইতিহাস কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায় কি না?

উত্তরে ডা. সায়েরা বানু শিউলী বলেন, ‘জিন মিউটেশনের কারণেই ক্যানসার হয়। কিন্তু পরিবার থেকেই জিনটা মিউটেট করে ক্যানসার হয়েছে, ব্যাপারটা এ রকম না–ও হতে পারে। বিভিন্ন গাইডলাইন মেনে আমরা মিউটেশন টেস্ট করে থাকি।’

ডা. সায়েরা বানু শিউলী আরও বলেন, ‘ফ্যামিলির মধ্যে নির্দিষ্ট কতজনের এই জিনটা আছে, থাকলে সেটা জানা আছে কি না, সেই জিনের ডিগ্রি কত, এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় মাথায় রেখে আমরা জেনেটিক টেস্টিংগুলো করে থাকি।’

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।

অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে একজন দর্শক ফেসবুকের মন্তব্য ঘরে প্রশ্ন করেন, ক্যানসার শেষ স্টেজে ছড়িয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে কী করা উচিত?

উত্তরে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, ‘স্তন ক্যানসার ফোর্থ স্টেজে চলে গেলেও সেটা যদি ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে রোগীরা একদম সুস্থ জীবন কাটাতে পারেন। শুধু সচেতন থাকতে হবে।’

বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের পরিস্থিতি, সার্জারি, রিস্ক ফ্যাক্টর, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. রাশেদুল হাসান, ডা. আলী আসগর চৌধুরী ও ডা. সায়েরা বানু শিউলী।

স্তন ক্যানসার আগে থেকে প্রতিরোধ করার প্রসঙ্গে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, ‘আগে থেকেই ক্যানসারের ঝুঁকি সম্পর্কে জানলে, সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি সার্জারির মাধ্যমে এই ঝুঁকিটা কমিয়ে ফেলা যায়। একই সঙ্গে মাসিক বন্ধ হওয়ার পরে নারীরা যদি নিজেদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখেন, অ্যালকোহল, ধূমপান ইত্যাদি বর্জন করেন, স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।’

স্তন ক্যানসারে কখন সার্জারি করা প্রয়োজন এবং সার্জারি কত ধরনের হতে পারে? এসব বিষয়ে ডা. রাশেদুল হাসান বলেন, ‘শরীরের যেকোনো অঙ্গের ক্ষেত্রে মূল চিকিৎসাটি সার্জারির মাধ্যমেই হয়ে থাকে। স্তনের ক্ষেত্রেও তাই। তবে ক্যানসার যখন অনেক অ্যাডভান্স বা একটু সিসিস্ট হয়ে যায়, তখন সার্জারি করা উচিত নয়।’

কীভাবে পরীক্ষা করলে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করা সম্ভব? উত্তরে ডা. সায়েরা বানু শিউলী বলেন, ‘নিজেই স্তন পরীক্ষা করে নারীরা দেখতে পারেন, এ ছাড়া এমআরআই এবং আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমেও তা করা যায়।’ এ ছাড়া স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে টিউমার বোর্ডের ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করেন ডা. সায়েরা বানু শিউলী। তিনি বলেন, ‘এবারের স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাসের প্রতিপাদ্য হলো, স্তন ক্যানসার কারোরই একা মোকাবিলা করা উচিত না। এটা রোগীর ক্ষেত্রে যেভাবে প্রযোজ্য, চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও সেভাবে প্রযোজ্য। মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম বা টিউমার বোর্ড থাকলে রোগীর চিকিৎসার জন্য কোন সিদ্ধান্তটি সঠিক হবে, সেটা নির্ণয় করা অনেক সহজ হয়।’

একবার স্তন ক্যানসার সেরে গেলে রোগী আবার ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন কি না? এর উত্তরে ডা. রাশেদুল হাসান বলেন, ‘স্তন যদি অস্ত্রোপচার করে ফেলেও দেওয়া হয়, সেই ক্ষেত্রেও ৩ থেকে ৫ শতাংশ ঝুঁকি থাকে। এর সঙ্গে যদি রেডিওথেরাপি যোগ করা হয়, সেই ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার ফিরে আসার ঝুঁকি ১০ বছর পিছিয়ে যায়।’

দেশে নাকি বিদেশে—ক্যানসারের চিকিৎসা কোথায় করানো লাভজনক? এ প্রসঙ্গে ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে এখন অসংখ্য দক্ষ সার্জন রয়েছে। তাঁরা আন্তর্জাতিক মানের সার্জারি করতে পারেন। আগে আমাদের রেডিওথেরাপি মেশিনের সংকট ছিল, এখন সেটা অনেকটাই কেটে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের ওষুধও তৈরি হচ্ছে। এসকেএফের ওষুধ বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আমি মনে করি, বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা দেওয়ার পর্যায়ে আমাদের দেশ পৌঁছে গেছে।’