ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু, তবু গা ছাড়া ভাব
এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে ৯৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এত মৃত্যুর পরও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গা ছাড়া ভাব যাচ্ছে না। তারা গতানুগতিক ধারায় কাজ করছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ, কীটতত্ত্ববিদ ও ডেঙ্গু রোগবিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ যেন প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করেনি। তাদের উদাসীনতায় ডেঙ্গু ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার আরও ১৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তাঁরা মারা গেছেন। একই সময়ে হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ১২৩ জন। এ নিয়ে এ বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৮১। আর মারা গেছেন মোট ৯৪৩ জন। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেন, হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি হন, তার চার থেকে পাঁচ গুণ রোগী বাড়িতে থাকেন।
সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করুক, কিন্তু স্বীকার করে নিক যে পরিস্থিতি জরুরি অবস্থার মতোই। এটা স্বীকার করে সবাইকে নিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজে নামলে, চিকিৎসার কাজে নামলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকার গতানুগতিকভাবে চলছে। তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যেন প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিয়েছে।মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্যবিদ
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সামনে পরিস্থিতি আরও কিছুটা খারাপ হতে পারে, এমন আশঙ্কাও আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত সোমবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘থেমে থেমে বৃষ্টি ও এখনকার আবহাওয়া মশার বংশ বিস্তারের জন্য উপযুক্ত। মশার উৎপত্তিস্থল কমানো সম্ভব না হলে মশা কমবে না। গত বছর দেখেছি অক্টোবর মাসে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ছিল। এ বছরও সেই আশঙ্কা দেখছি।’
ঠিকমতো কাজ করেনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেন, সংক্রমণ কম থাকে এমন সময়ই তা নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে সহজ হয়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তা করেনি।
মশা জরিপের ওপর ভিত্তি করে এ বছরের শুরুর দিকে কীটতত্ত্ববিদেরা আশঙ্কা করে বলেছিলেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। তখন সংক্রমণ কম ছিল। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণের কিছু কাজে করেছে। তবে পরিকল্পনার অভাব, জনবল-ঘাটতি, মাঠকর্মীদের গাফিলতি সর্বোপরি নজরদারির অভাবের কারণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ ঠিকমতো হয়নি। ঢাকায় মশার পাশাপাশি ডেঙ্গু বেড়েছে। সেই ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়েছে।
জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২২। তখন পর্যন্ত মশা নিয়ন্ত্রণে জোর দেয়নি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। জুন থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। এ অবস্থায়ও জেলায় জেলায় মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মাত্র এক মাস আগে কাজ করার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। এরা মোট রোগীর ৫৮ শতাংশ। এদের একটি অংশ গ্রামে বাস করে। গ্রামের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের কোনো বিভাগ থেকে কোনো তথ্য আলাদা করে পাওয়া যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও স্বীকার করে। গত সোমবার স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শের আলী প্রথম আলোকে বলেন, এ পরিপ্রেক্ষিতে যেসব জেলায় ডেঙ্গু রোগী বেশি সেখানকার জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনদের নিয়ে বৈঠক করে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও মশক নিধন কার্যক্রম ও জনসচেতনতা বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে মশকনিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও প্রচারের জন্য ৩২৯টি পৌরসভার জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কিস্তির প্রায় ৫ কোটি টাকা গত ১৬ আগস্ট ছাড় করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
নজর নেই গ্রামে
এ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। এরা মোট রোগীর ৫৮ শতাংশ। এদের একটি অংশ গ্রামে বাস করে। গ্রামের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের কোনো বিভাগ থেকে কোনো তথ্য আলাদা করে পাওয়া যায়নি।
কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, দুই ধরনের এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। শহর এলাকায় এডিস ইজিপ্টাই ও গ্রাম এলাকায় এডিস এলবোপিকটাস ডেঙ্গু ছড়ায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামে ডেঙ্গুর বাহক ভিন্ন। এডিস এলবোপিকটাস মশা গাছের পাতায়, বাকলে জমে থাকা পানিতে জন্মাতে পারে। তাকে ভিন্নভাবে মোকাবিলা করতে হবে। শহরের মতো করে গ্রামের মশা মারা যাবে না। গ্রামের মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিকল্পনা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, শহরের মানুষকে পানি জমিয়ে রাখতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু গ্রামের মানুষের এ ক্ষেত্রে বিকল্প কী, তা-ও বলে দেওয়া দরকার।
গ্রামের মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য পৃথক কোনো পরিকল্পনা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নেই। গ্রামের মানুষ জমে থাকা পানির ব্যাপারে কী করবে, সেই বার্তাও দেওয়া হচ্ছে না।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শের আলী জানান, ‘পৌরসভার পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদগুলোর জন্যও মশকনিধনে বরাদ্দ দেওয়া হবে। বরাদ্দ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।’
শিক্ষা নেয়নি বাংলাদেশ
২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর কোনো বছর মানুষ আক্রান্ত বেশি হয়েছেন, কোনো বছর বেশি মারা গেছেন। কিন্তু গত ২৩ বছরেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা সরকার করেনি। প্রতিবছর ডেঙ্গু মৌসুমে সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসে। ডেঙ্গু কমে এলে সব কাজ থেমে যায়। এ বছরও সরকার অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছে, আপনাআপনি ডেঙ্গু কমে আসার আশায়।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় ডেঙ্গু বাড়বে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, বেশি পরিমাণে উড়োজাহাজ ভ্রমণ এবং অপর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থার কারণে ডেঙ্গু বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। কিন্তু সরকার সেই কথা শোনেনি। দীর্ঘ মেয়াদে কোনো পরিকল্পনা করেনি।
বর্তমান অবস্থায় স্বাস্থ্য বিভাগ কী করছে, জানতে চাইলে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রেখেছে। রোগী ব্যবস্থাপনার ওপর নজরদারি করছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বারবার বলে আসছেন, মৃত্যু কেন বেশি হচ্ছে, তা মৃত্যু পর্যালোচনা থেকে জানা সম্ভব। মানুষ বিলম্বে আসার কারণে জটিলতা বাড়ছে, নাকি রোগী ব্যবস্থাপনায় কোনো সমস্যা হচ্ছে, তা স্পষ্ট হওয়ার জন্য মৃত্যু পর্যালোচনা দরকার।
২৭ আগস্ট রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেছিলেন, মৃত্যু পর্যালোচনা চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু পর্যালোচনার তথ্য জনসমক্ষে আনা হবে।
এক মাস পরও ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনার কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কেউ বলতে পারছে না। ১ জুলাই থেকে গতকাল ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ এই ৮৮ দিনে গড়ে প্রতিদিন ১০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ আশঙ্কা করছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকবে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, পেরু এবং এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। গত সোমবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (ইসিডিসি) ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এ বছরের ৩২তম সপ্তাহ (আগস্ট) পর্যন্ত ব্রাজিলে আক্রান্ত ছিলেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৮ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯১২ জন। বছরের ৩৬তম সপ্তাহ পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ পেরুতে আক্রান্ত ছিলেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ১৯৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪১৯ জন।
এরপর বেশি মৃত্যু দেখা যাচ্ছে এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনে। দেশটিতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৩৪ জন। আর আক্রান্ত হয়েছেন ৬৮ হাজার ৬৮ জন। প্রতিবেশী দেশে ভারতের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ন্যাশনাল সেন্টার ফর ভেক্টর বর্ন ডিজিজেস কন্ট্রোলের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দেশটিতে এ পর্যন্ত ৩১ হাজার ৪৬৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৩৬ জন। তবে এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের তথ্য নেই।
এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগীদের মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি—শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ৩৮তম সপ্তাহ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৮১ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯৪৩ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করুক, কিন্তু স্বীকার করে নিক যে পরিস্থিতি জরুরি অবস্থার মতোই। এটা স্বীকার করে সবাইকে নিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজে নামলে, চিকিৎসার কাজে নামলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকার গতানুগতিকভাবে চলছে। তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যেন প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিয়েছে।’