সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আমার লেখা প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান বইয়ের নাম দেখে অনেকেরই মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। এটা হচ্ছে তাদের না জানা কিংবা না বোঝার ক্ষমতা।
বাংলাদেশের উত্থান হলো একটি জনগোষ্ঠীর জেগে ওঠার মহাকাব্য। এর পরতে পরতে আছে যুগ যুগ ধরে মানুষের যূথবদ্ধ প্রয়াস। এখানে অনেক কারিগর, অনেক বীর। সিরাজুল আলম খান তেমনই একজন, একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যিনি শ্রম-ঘাম-মেধা দিয়ে বাংলাদেশের উত্থানপর্বে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন।
ষাটের দশকে অনেক ছাত্রনেতাই মাঠ কাঁপিয়েছেন। অন্যদের সঙ্গে তাঁর ফারাক হলো, তিনি লেগে ছিলেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাথার ওপর ছায়াটি আর ছিল না। আওয়ামী লীগ অফিসে বাতি জ্বালানোর লোক ছিল না। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম পুরানা পল্টনের অফিস আগলে রেখেছিলেন আর সিরাজুল আলম খান ব্যাপৃত ছিলেন ছাত্রদের সংগঠিত করার কাজে। তাঁকে পথ চলতে হয়েছে নিজ শক্তিতে ও বুদ্ধিতে। সঙ্গে পেয়েছেন অনেক উদ্যমী তরুণকে। সবাইকে ছাঁচে ঢেলে তিনিই তৈরি করেছেন, এমন নয়। সবার মনেই স্বপ্ন ছিল। সিরাজুল আলম খান হয়ে উঠলেন তরুণ মনের স্বপ্নের সওদাগর। তিনি নিজেই বলেছেন, শেখ মুজিবের ছয় দফা তাঁর বুকে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। উনসত্তরে মুজিব যখন জেল থেকে ছাড়া পান, দেখলেন তাঁর জন্য জমি তৈরি হয়ে আছে, যার ওপর ভরসা করে বীজ বোনা যায়। জমি তৈরির এ কাজ করেছেন সিরাজুল আলম খান। শেখ মুজিবকে নেতা মেনেই তিনি এটা করেছেন। এখানে তিনি মুজিবের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নন। বরং বলা যায় ‘প্রডিজে’। এর যথার্থ প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া ভার। কাছাকাছি শব্দ হলো আস্থাভাজন শিষ্য ও সহযাত্রী। এ ধরনের একটা সম্পর্ক দাঁড় করালে শেখ মুজিব ছোট হয়ে যান না, সিরাজুল আলম খানকেও অপাঙ্ক্তেয় ঘোষণা করতে হয় না।
বাংলাদেশের জন্মের পরের বছরগুলো জটিল ও স্পর্শকাতর। প্রশ্ন ছিল, দেশ কি প্রস্তুত হওয়ার আগেই স্বাধীন হয়ে গেছে? একটি স্বাধীন দেশ কীভাবে চলবে, তার কি কোনো রূপকল্প ছিল? এ তো মধ্যরাতের ক্ষমতার হাতবদল ছিল না। অথচ ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলের নিয়মকানুন আর রাষ্ট্রব্যবস্থা না পাল্টে তাকে ঝাড়পোঁছ দিয়ে চালানো শুরু হলো। এটা ছিল মানুষের আকাশছোঁয়া আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অনেকাংশে সংগতিহীন। তাই প্রতিক্রিয়া হলো বিষম। আওয়ামী লীগের সনাতন ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন সিরাজুল আলম খান।
প্রতিনায়ক হলো বিদ্রোহী নায়ক, কিংবা বলা যেতে পারে বিকল্প নায়ক। এ দেশে নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। সঙ্গে পেলেন একঝাঁক টগবগে তরুণ। তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন। বিদ্রোহ না করলে তাঁরাই হয়তো দল এবং দেশটা চালাতেন। তাঁরা বিদ্রোহ করায় দেশের একটা বড় ক্ষতি হলো। দেশটা গিয়ে পড়ল একদল মেধাহীন, লোভী ও মতলববাজের হাতে, যারা নিজের ও পরিবারের স্বার্থের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না।
সিরাজুল আলম খানকে কেউ কেউ ষড়যন্ত্র–তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। যে লোকটির কোনো কিছুর প্রতি লোভ নেই, যে তরুণেরা ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ জ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা কী করে ষড়যন্ত্রকারী হন?
সিরাজুল আলম খানের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ, তিনি তরুণ একটা প্রজন্মকে ভুল পথে নিয়ে গেছেন। তিনি কি জোর করে তাদের ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে গেছেন? আসলে স্বপ্নবাজ তরুণেরা তাঁর মধ্যে নিজেদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। স্বপ্ন দেখা তো অপরাধ নয়!
সিরাজুল আলম খানের কোনো ঘর নেই, সংসার নেই, প্লট নেই, বাড়ি-গাড়ি নেই। এ রকম একজন মানুষ ক্ষমতাসীন ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরামহীন গিবতের শিকার হয়েছেন। অসুস্থ অবস্থায় অনেক দিন হাসপাতালে ছিলেন। যাঁরা একসময় তাঁর অনুগ্রহপ্রত্যাশী ছিলেন, পরে তাঁকে গালাগাল করতেন ও তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন, তাঁরা অনেকেই হাসপাতালে ভিড় করেছেন তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলতে। সেখানে ভালোবাসা ছিল না। তাঁর জন্য কে শোক জানিয়ে বিবৃতি দিল কি দিল না, তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি এখন এসবের ঊর্ধ্বে। তাঁর সব কষ্টের অবসান হলো।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আমার অনুভূতি পঙ্ক্তিমালা দিয়ে শেষ করছি:
আজ আমি তোমাদের একটা আনন্দসংবাদ দেব
আজ এই গৃহে একজন লোকান্তরিত হলেন
আকাশে উড়ছে সুন্দর ধূসর কাক
ছাদে কার্নিশে ল্যাম্পপোস্টে আরও কয়েকটা
তারস্বরে বলছে সবাই আনন্দ কর
কেননা তার কষ্টের দিন শেষ হলো আজ
তার চারপাশে সবাই ছিল
তার চারপাশে কেউ ছিল না
তার ঘর ছিল আশ্রয় ছিল না
তার সঙ্গী ছিল বন্ধু ছিল না
কারও আস্থা ছিল না বিশ্বাস ছিল না
আশা ছিল না ভালোবাসা ছিল না
এখন লোকটি অন্যের কাঁধে চড়ে
হাসতে হাসতে অনন্তলোকে যাত্রা করবে।