কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ৫ আগস্ট দ্বিতীয় বিজয় পেলেও সেটিকে পূর্ণ বিজয় করা যায়নি। এটি একটি অপূর্ণ বিজয় হয়েছে। পুরো রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই অপূর্ণ বিজয়কে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিতে চাইলে প্রধান রাজনৈতিক কাজ হবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই এখন সবচেয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে। গ্রামে গ্রামে, বিভিন্ন কলেজে তরুণদের মধ্যে এই আলোচনা ছড়িয়ে দিতে হবে।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে ফরহাদ মজহার এসব কথা বলেন। আজ সোমবার বিকেলে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে এই বক্তৃতা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।
ছাত্র–জনতার জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থান যেটি হয়েছে, এটি কিন্তু পূর্ণ বিজয়ের দিকে যায়নি। আমরা যেভাবে আশা করেছিলাম, সেই বিজয় কিন্তু আমরা অর্জন করতে পারিনি। ফলে গণ–অভ্যুত্থানটি অপূর্ণ রয়ে গেছে। একে যদি আমরা পূর্ণ করতে চাই, পূর্ণ করা মানে একটি গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করা, পুরোনো সংবিধানের অধীনে না। দরকার ছিল একটা ঘোষণা দেওয়ার, জনগণের পক্ষে, যেসব পুরোনো আইন ভেঙে দিয়ে নতুন আইন বা নতুন রাষ্ট্র গঠন করার প্রতিশ্রুতি। এখানে গঠন শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে পুরোনো জিনিস ভেঙে গেছে, আমরা এখন নতুনভাবে নিজেদের নিজেরা গঠন করব।’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এই যে চব্বিশে গণ–অভ্যুত্থান হয়ে গেল, ৫ আগস্ট বললেন আমরা দ্বিতীয় বিজয় পেয়েছি। দ্বিতীয় বিজয় আমরা পেয়েছি। কিন্তু আমরা এই বিজয়টাকে পূর্ণ বিজয় করি নাই। এটি একটি অপূর্ণ বিজয় হয়েছে। কারণ আমরা কী করেছি, আমরা একটি রাষ্ট্র গঠন করেছি, যেই রাষ্ট্রটা এর আগে যে ফ্যাসিস্ট সংবিধান শেখ হাসিনার প্রণীত, আমরা পুরো রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে ঢুকিয়ে দিয়েছি।...সংবিধানের নামে, আইনের নামে।’
ফরহাদ মজহার বলেন, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ এখনো পর্যন্ত রাজনীতি ও আইনের সমন্ধ সম্পর্কে জানেন না। যদি জানতেন তাহলে তাঁরা বলতেন গণ–অভ্যুত্থানের পর পুরোনো আইনের মধ্যে ঢোকানোর কোনো অর্থ নাই, এটি একটি ঠাট্টা–তামাশা ছাড়া কিছু না। সত্যিকার এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করা হয়নি। যদি করা হতো, তাহলে আইন ও রাজনীতির সম্বন্ধে অনেক আগে থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে স্পষ্ট থাকত এবং তরুণেরা, যারা এই গণ–অভ্যুত্থানটি করেছে তারা বুঝতে পারত যে গণ–অভ্যুত্থানের পরে তারা শপথ গ্রহণ করবে জনগণের কাছে এবং তারা ক্ষমতায় যাবে একটি ঘোষণার মাধ্যমে, যেটিকে বলে প্রোক্লেমেশন, কোনো আইনের দ্বারা না, পুরোনো সমস্ত আইন বাতিল হয়ে গেছে। তাকে বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এটি আমরা পারি নাই।’
ফরহাদ মজহার বলেন, যদি ৫ আগস্টের অপূর্ণ বিজয়কে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিতে চাই তাহলে কী লাগবে, তাহলে প্রধান যে রাজনৈতিক কাজ সেটা হলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইটি এখন যেকোনো কারণে সবচেয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করতে হবে, এটা এখনকার প্রধান কর্তব্য।
‘রিকনসিলিয়েশন ও রিকনস্ট্রাকশন কাউন্সিল’ গঠন করার কথা বলে আসছেন জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, এর মাধ্যমে যাঁরা ভুল করেছেন, কেন ভুল করেছেন, তা উপলব্ধি করবে। এ ক্ষেত্রে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার করা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের প্রসঙ্গও টানেন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বিপুল মানুষের ভিড় দেখার কথা তুলে ধরেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, অনলাইন প্রচারণায় এমন একটি পক্ষ আছে, যারা জোরগলায় দাবি করে এবারের বিজয় দিবসের প্রতি মানুষের আগ্রহ অপেক্ষাকৃত কম থাকার কথা। আরেকটি পক্ষ আছে যারা স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, একাত্তরের যুদ্ধ ও বিজয় দিবস—এই ব্যাপারগুলোকে নানাভাবে মাহাত্ম্য হ্রাস করে দেখানো, সম্মান হ্রাস করে দেখানের একটি প্রচারণার মধ্যে আছে। কিন্তু এই দুই পক্ষকে মোটেই গুরুত্ব না দিয়ে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছে, এটিই আসলে বাংলাদেশ।