‘বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক অনলাইন গোলটেবিল আলোচনা
কিশোরীদের স্বাস্থ্যসচেতনতায় সবাইকে তৎপর হতে হবে
বয়ঃসন্ধিকাল একজন মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশেষ করে নারীদের। কারণ, এই সময়টায় একজন নারীর ‘পরিপূর্ণ নারী’ হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয়। বয়ঃসন্ধিকালের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পেডিয়াট্রিক অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (পিএজিএসবি) অনলাইনে আয়োজন করে ‘বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা। এতে দেশবরেণ্য নারীস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন।
গোলটেবিল আয়োজনটির সহযোগিতায় ছিল এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং নলেজ পার্টনার ছিল অস্টাক্যাল জিএক্স ও এথিনর। অনুষ্ঠানটি গতকাল বুধবার সরাসরি প্রচার হয় প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিএজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক কোহিনূর বেগম। প্রধান অতিথি ছিলেন ওজিএসবির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান।
এ ছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম, অধ্যাপক লায়লা আরজুমান্দ বানু ও অধ্যাপক রওশন আরা বেগম, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক সেহেরিন ফরহাদ সিদ্দিকা, বর্তমান মহাসচিব অধ্যাপক সালমা রউফ, সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি অধ্যাপক ফাতেমা রহমান; পিএজিএসবির ট্রেজারার অধ্যাপক ইফফাত আরা এবং বাংলাদেশ মেনোপেজ সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক এস কে জিন্নাত আরা নাসরীন। গোলটেবিল অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন পিএজিএসবির মহাসচিব অধ্যাপক গুলশান আরা।
এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সহযোগী পরিচালক (বিপণন) বিনয় দাস, মহাব্যবস্থাপক ডা. মিজানুর রহমান ও ব্যবস্থাপক ডা. মুরাদ হোসেন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য অতিথিদের ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন পিএজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক কোহিনূর বেগম। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা সাধারণত ১০ থেকে ১৯ বছর। আমরা অনেকেই ভাবি, এই বয়সে আবার কীসের অসুখ–বিসুখ? কিন্তু এই বয়সটাতেই একজন নারী শারীরিক ও মানসিক নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যায়। এই সমস্যা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে। এই বয়সটি যেহেতু ভবিষ্যতের ভিত্তি, তাই আমাদের সবাইকে নিজ নিজ পরিবারের মেয়েদের বিষয়ে সচেতন হতে হবে।’
অধ্যাপক কোহিনূর বেগম আরও বলেন, ‘এ সময় কিছু স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। যেমন স্যানিটারি প্যাড বা পরিষ্কার শুকনো কাপড় ব্যবহার করতে হবে। ট্যাম্পন ব্যবহার স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এটির কারণে বিপরীতমুখী মাসিকের ফলে এন্ডোমেট্রিওসিস ও ইনফেকশন হতে পারে। মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি যেভাবে পরিষ্কার করা উচিৎ, তা অনেক সময় সম্ভব হয় না, ফলে জরায়ু ও জননতন্ত্রের ইনফেকশন এবং ক্ষেত্রবিশেষে ‘‘একটপিক প্রেগন্যান্সি’’ হতে পারে। অতিরিক্ত ভারী কাজ ও ব্যায়াম থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে সাধারণ চলাফেরা ও ব্যায়াম জরুরি। তাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও ব্যথা, কোমরের ব্যথা কমে যায় এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এর পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে আয়রণযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে।’
গোলটেবিল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন পিজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক গুলশান আরা। বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা অবিহেলিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কিশোরীর বয়ঃসন্ধির এই সময়টাকে তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। বিশ্বব্যাপীই এটা পরিবারে ও সমাজে অবহেলিত একটি বিষয়। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যকর্মী সবাই এই বিষয়ে অবগত আছেন। নিজ নিজ জায়গা থেকে তাঁরা কাজ করছেন। আশা করছি, ভবিষ্যতে আমাদের ফুলের মতো এই কিশোরীরা সুন্দর, সুস্থ পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে বড় হবে।'
এরপর বক্তব্য দেন অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান। তিনি বলেন, ‘বয়ঃসন্ধিকাল এমন একটি সময়, যা নারীর জীবনের একটা সেতু। এর মাধ্যমে পরিণত জীবনে প্রবেশ শুরু করে কিশোরীরা। এই সময়টাতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কিশোরীরা এই বয়সটাতে তাদের শারীরিক সমস্যাগুলো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে না। তারা সংকোচ বোধ করে। এই সংকোচ কাটিয়ে ওঠার জন্য পরিবারের সবাইকে সহায়তা করতে হবে। মায়েরা তো পুরো বিষয়টাই দেখাশোনা করেন।
পরিবারের অন্য সদস্য ও স্কুলশিক্ষকেরা যদি কিশোরীটির পাশে এসে দাঁড়ান, তখন সে আর সংকোচ করবে না। দ্বিধা কাটিয়ে সচেতন হবে। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি কিশোরী আছে। এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই তাদের স্বাস্থ্যসচেতনতায় আমাদের তৎপর হতে হবে।’
এ সময়ে একজন কিশোরী মানসিক নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যান। কিশোরীর মানসিক বিপর্যয় নিয়ে অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম বলেন, ‘এই সময়টাতে একজন কিশোরী কখনো কান্না করে, কখনোবা বিষণ্ন কিংবা একেবারে চুপ হয়ে যায়। এককথায়, কিশোরী মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যায়। তাকে বোঝাতে হবে, এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আসলে তার পাশে থাকাটাই মানসিক বিপর্যয় প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায়।’
অধ্যাপক ইফফাত আরা বলেন, ‘হরমোনের কারণে নাক-চোয়ালে যে চুল ওঠে তা চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিহত করা যায়। এটা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কিছু নেই।’
এ সময়ে কিশোরীদের মেটাবলিক সিম্পটম নিয়ে অধ্যাপক এস কে জিন্নাত আরা নাসরীন বলেন, ‘মেটাবলিক সিম্পটমকে খুব সহজ ভাষায় আমি বোঝাতে পারি, কৈশোরের এ সময়টাতে মেয়েদের হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া, উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল, রক্তে চিনি—এ–জাতীয় সমস্যা। এ রকমটা দেখা দিলে প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।’
এখন অনেক নারীকেই দেখা যায় বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন। এর শুরুও হয় বয়ঃসন্ধিতে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ফাতেমা রহমান বলেন, ‘কিশোরীদের যদি ঠিক সময়ে টিকা দেওয়া হয়, হরমোনের নানান ধরনের ভ্যাকসিন আছে, এখন যা ১০-১৪ বছরের কিশোরীদের জন্য বরাদ্দ, তারা যদি সেগুলো গ্রহণ করে তাহলে ভবিষ্যতে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে।’
‘অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীর বয়ঃসন্ধির ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণা নেই। তারা জানেও না সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা কোথায় পাওয়া যায়। স্কুলের বইতে শুধু একটি অধ্যায়েই কৈশোরকালীন শারীরিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা রয়েছে, যা মাসিক ও বয়ঃসন্ধি নিয়ে নিতান্তই লঘু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। খুব কমসংখ্যক স্কুলে মাসিকবান্ধব প্রক্ষালন সুবিধা আছে, কাগজে-কলমে সে সুবিধা থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে আছে কতটা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।’ এমন মন্তব্য করেন অধ্যাপক রওশন আরা বেগম।
বয়ঃসন্ধিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাসিক বা পিরিয়ড। এ সময়ের স্বাস্থ্যসচেতনতার বিষয়ে অধ্যাপক সেহেরিন ফরহাদ সিদ্দিকা বলেন, ‘মাসিক বা ঋতুস্রাব প্রত্যেক নারীর স্বাভাবিক জীবনচক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও এটি নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো স্বাভাবিক নয়। এমনকি পিরিয়ড নিয়ে পরিচিতদের কাছে তাচ্ছিল্যের শিকার হন অনেকে। যদিও দিন দিন মানুষের মধ্যে ট্যাবু ভাঙছে, সচেতনতা বাড়ছে।
ন্যাশনাল হাইজিন ফলোআপ সার্ভে ২০১৮ অনুসারে, মাত্র ৫৩ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের ব্যাপারে জানে। ৩০ শতাংশ ছাত্রী মাসিক চলাকালে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। ৩৪ শতাংশ কিশোরী মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে তাদের এটা খুব ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। আর প্যাড ব্যবহারকারীরা ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার বেশি প্যাড ব্যবহার করবে না। এটা মেনে চললে কিশোরীরা আর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে না।’
গোলটেবিলের সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন, ‘আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া বয়ঃসন্ধিকালীন প্রধান রক্তশূন্যতা গঠন করে। একজন কিশোরী যেন জীবনের শুরুতে রক্তশূন্যতায় না ভোগে, তা খেয়াল রাখতে হবে। এই সময়টাতে স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন ফল, শাকসবজি, কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য, চর্বিহীন প্রোটিন, পানি এবং চিনিমুক্ত পানীয় গ্রহণ করতে হবে।
এখন তো খেলার মাঠ নেই। তাই স্কুলে যেন খেলতে পারে, সেদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষের নজর দিতে হবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে হাঁটা, দড়িলাফ এমন শরীরচর্চা নিয়মিত করতে হবে। এগুলো আমাদের কিশোরীদের স্বাস্থ্য ভালো রাখবে।’