বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে উজ্জ্বল একটি দিন
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে চ্যানেল আই নির্মাণ করেছে ‘এক মহামান্যের গৌরবগাথা’।
বঙ্গভবনে প্রথম যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আশির দশকের শেষ দিকে। তবে সে সময় রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত পৌঁছানো হয়নি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন রাষ্ট্রপতি। বঙ্গভবনই তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মূল কেন্দ্র। আমার দূরসম্পর্কের এক মামা ছিলেন বঙ্গভবনের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা। গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। মনে পড়ে, বঙ্গভবনে ঢোকার অভিজ্ঞতার আনন্দই আমাকে অধীর করে রেখেছিল। বয়স তখন ছিল কম।
এরশাদের পর ক্ষমতার পালাবদলে বঙ্গভবন হয়ে উঠল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আলংকারিক মর্যাদার প্রতীক। কখনো কাজের প্রয়োজনে, কখনোবা মহামান্য রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে বঙ্গভবনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ফরিদুর রেজা সাগর (চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) আর আমার। তবে সবচেয়ে বেশি সুযোগ হয়েছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে যাওয়ার।
বিভিন্ন সময় মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠানে আমরা উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছি। মনে পড়ে, একবার এক কৃষকের অনুরোধে সূর্যপুরী আর হাঁড়িভাঙ্গা আমের চারা রোপণ করতে গিয়েছিলাম বঙ্গভবনে। আরেকবার রাষ্ট্রপতির সৌজন্যে আমাদের প্রযোজনা করা ফাগুন হাওয়া চলচ্চিত্রের একটা বিশেষ প্রিমিয়ার শোর আয়োজন করা হয়েছিল বঙ্গভবনে। সাগর আর আমি সপরিবার উপস্থিত ছিলাম উৎসবমুখর এক পরিবেশে।
এবার আমাদের বঙ্গভবনে যাওয়া হলো একেবারেই ভিন্ন এক উদ্দেশ্যে। চ্যানেল আইয়ের দর্শকদের জন্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের একান্ত সাক্ষাৎকার নেবে সাগর। অনুষ্ঠানটি নির্মাণের দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর।
দেশের কুড়ি ও একুশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবন থেকে গত ১০ বছর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে প্রত্যন্ত ভাটি অঞ্চলের মিঠামইন থেকে উঠে এসেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার যোগ্য রাজনৈতিক সারথি হিসেবে সমাসীন হয়েছেন বঙ্গভবনে।
যে ব্যতিক্রমী জ্যোতিষ্কদের কিরণে বঙ্গভবন উজ্জ্বল, তাঁদের অন্যতম আবদুল হামিদ আর কদিন পরই রাষ্ট্রপতির আসন ছেড়ে বঙ্গভবন থেকে ফিরে যাবেন সাধারণ মানুষের সমাজে। তিনি আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপতির আসনে উপবিষ্ট থাকা একজন। তাঁর সারল্য, রসবোধ ও জনপ্রিয়তা বঙ্গভবনকে মানুষের কাছে এনেছে।
বঙ্গভবনের ইতিহাস সুদীর্ঘ। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজত্বে বঙ্গভঙ্গের পর এখানে যে নতুন প্রদেশ হয়, তার রাজধানী হলো ঢাকা। প্রধান শাসনকর্তা লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অফিস ও বাসভবনের জন্য ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহর দিলকুশার বাগানবাড়িতে নির্মিত হয় গভর্নমেন্ট হাউস। পরের বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি হয় এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। ঢাকা আর রাজধানী না থাকলেও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বহু ব্রিটিশ গভর্নর গভর্নমেন্ট হাউস নামে পরিচিত এই ভবনে থেকেছেন। দেশভাগের পর ঢাকা হলো প্রাদেশিক রাজধানী। নতুন প্রাদেশিক শাসনকর্তা গভর্নরের দপ্তর ও বাসস্থান হলো ব্রিটিশ আমলের দিলকুশা গভর্নমেন্ট হাউস। এবার এর নাম হলো গভর্নর হাউস। ১৯৬৪ সালে গভর্নর হাউসটি নতুন আঙ্গিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর গভর্নর হাউসে মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় ভবনটির নতুন নাম দেওয়া হয় বঙ্গভবন। এটিকে করা হয় রাষ্ট্রপতির দপ্তর ও বাসভবন।
বঙ্গভবন গড়ে উঠেছে মতিঝিল থানার দিলকুশা এলাকায় প্রায় সাড়ে ২৩ হেক্টর জমির ওপর। চতুর্দিকে উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও বাসভবন ছাড়াও রয়েছে উন্মুক্ত পরিসর; নানা প্রজাতির ফুল, ফল, ভেষজ ও বাহারি গাছের সমন্বয়ে মনোরম উদ্যান; হরিণ-বানর ছাড়াও নানা জাতের পাখপাখালি আর পুকুর ও দিঘি।
বঙ্গভবনের স্থাপত্যকলাও দৃষ্টিনন্দন। মূল ভবনে রয়েছে ঐতিহাসিক দরবার হল। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান হয় দরবার হলে। বঙ্গভবনের ঐতিহ্যবাহী স্মারক এই দরবার হল।
ব্রিটিশ ও মোগল স্থাপত্যশৈলীতে গড়ে ওঠা এই ভবন মর্যাদাবান হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের এক অনন্য প্রতীক হিসেবে।
আমাদের নির্মাণদলের সঙ্গে সাগর আর আমি বঙ্গভবনে উপস্থিত হলাম। বঙ্গভবনে প্রবেশের জন্য আছে তিন ধরনের ভিজিটর (দর্শনার্থী) পাস। নীল রঙের সাদা ভিজিটর পাসে বঙ্গভবন চত্বর অব্দি যাওয়া যায়। সবুজ রঙের পাসে দরবার হল এলাকা পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি। রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ পেতে হলে লাগবে লাল রঙের পাস।
আমরা দরবার হলে পৌঁছালাম (গত শনিবার)। রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকারটি কোথায় ধারণ করলে উত্তম হয়, বঙ্গভবনে আমরা তেমন একটি জায়গা খুঁজছি। আমরা এমন একটি জায়গা বের করতে চাইছিলাম, দর্শকেরা সচরাচর যা দেখতে পান না। জায়গাটিতে যেন আবার রাষ্ট্রপতির সুদীর্ঘ সময়ের স্মৃতি আর অভিব্যক্তির গভীরতাও প্রতিফলিত হয়। বেছে নেওয়া হলো দরবার হলের পাশে উত্তর প্লাজার দিঘল টানা বারান্দাটি। এর সবুজ ঘাসের বিশাল লন। ফুলের বাগান। বঙ্গভবনের মোগল স্থাপত্যের ইশারাও এখানে ধরা পড়ে।
সূর্যের প্রচণ্ড তাপ। এর মধ্যেই ক্যামেরা প্রস্তুত। প্রস্তুত আমরাও। অপেক্ষা এখন রাষ্ট্রপতির আগমনের। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাউদ্দিন ইসলাম জানালেন, রাষ্ট্রপতি আসার আগে দুটি ঘণ্টা বাজবে। প্রথম ঘণ্টার মানে তিনি আসবেন, দ্বিতীয়টির মানে তিনি আসছেন।
দুটি ঘণ্টাই বাজল। রাষ্ট্রপতি এলেন। বসলেন তাঁর নির্ধারিত আসনে। ক্যামেরা স্ট্যান্ডবাই। আমি চিত্রগ্রাহকের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ রেখেছি ক্যামেরার চোখে।
সাগর সাক্ষাৎকার শুরু করল। ধীরে ধীরে সাগর তার স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমায় ধীরস্থির কণ্ঠে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে ধরতে লাগল রাষ্ট্রপতির সামনে। রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বভাবসুলভ সারল্য আর রসিকতায় বলে গেলেন তাঁর জীবনের নানা অধ্যায়, বঙ্গভবনের বহু না বলা কথা।
আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম সেসব গল্প। কখন যে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ল। আমরা টের পেলাম আলো কমে আসার পর। এরই মধ্যে কত অপূর্ব কথা, কত আকর্ষণীয় গল্পই না উঠে এল।
রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে যখন বিদায় নিয়ে ফিরছি, কেমন এক শূন্যতার অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। অনন্য মানুষটি এত দিন আলো করে রেখেছিলেন বঙ্গভবন। ২৪ এপ্রিল তিনি চলে যাবেন। যেসব গল্প এতক্ষণ তিনি আমাদের সঙ্গে করলেন, তার সব স্মৃতি রেখে যাবেন পেছনে। বঙ্গভবনে আরও অনেকেই আসবেন এবং যাবেন। আমরা দুই বন্ধু মিলে বিরল এক জ্যোতিষ্কের স্মৃতি ধরে রাখলাম।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে আমরা নির্মাণ করেছি ‘এক মহামান্যের গৌরবগাথা’। ২৩ এপ্রিল রাত ১১টা ২০ মিনিটে চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত হবে সে অনুষ্ঠান। দর্শকদের সেটা দেখার আমন্ত্রণ রইল।
সবাইকে ঈদ মোবারক।
শাইখ সিরাজ, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই