পরিকল্পিত আবাসিক কল্পলোকের রাস্তায় জ্বলে ‘বোতলের বাতি’
পানি জমে আছে কাঁচা রাস্তায়। কাদায় একাকার সড়ক। নেই পর্যাপ্ত সড়কবাতি। কোনো গ্রামে নয়; চট্টগ্রাম শহরের বাকলিয়ায় অন্যতম ‘পরিকল্পিত’ আবাসিক এলাকা ‘কল্পলোক’-এ গেলে এমনটা চোখে পড়ে।
অন্ধকার থেকে রক্ষা পেতে স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছেন। বোতল কেটে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে লাগিয়ে বাতি ঝোলানো হয়েছে। গত শুক্রবার সরেজমিন এসব চিত্র দেখা যায়।
কল্পলোক আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিকের মূল সড়কগুলো এখনো কাঁচা। ইট বসানো সড়কে নেই পিচ ঢালাই (কার্পেটিং)। কাঁচা সড়কগুলোয় বর্ষায় চলাফেরা করা যায় না। নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সড়কে জমে থাকে পানি। মূল সড়কের সঙ্গে যুক্ত অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর অবস্থাও বেহাল। গর্ত সৃষ্টি হয়েছে সড়কে। এসব সড়ক ও প্লটের খালি জায়গায় আবর্জনা ফেলছেন বাসিন্দারা।
কল্পলোক সমাজকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে নিয়মিত গৃহকর পরিশোধ করেন এলাকাবাসী। কিন্তু ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।
নগরের বিভিন্ন এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হলেও এই এলাকায় হয় না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। এখানে গৃহস্থালি বর্জ্য পরিষ্কারে আসেন না সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
১৯৯৫ সালে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নগরবাসীর আবাসন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাকলিয়া এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড় ঘেঁষে কল্পলোক আবাসিক (প্রথম পর্যায়) প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এরপর ২০০৫ সালে ৯০ একর জমি অধিগ্রহণ করে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়।
২০০৫ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ২৭৭ কোটি ৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয়ে কল্পলোক আবাসিক এলাকা (২য় পর্যায়) গড়ে তোলা হয়। বিভিন্ন আকারে ১ হাজার ৩৬৫টি প্লট তৈরি করা হয়েছিল। প্রতি কাঠা প্লট ৬ লাখ টাকা করে বিক্রি করে সিডিএ। ২০১৪ সালের মধ্যে প্লটগুলো মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেখানে ভবন নির্মাণ শুরু করেন প্লটের মালিকেরা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান নানা ভোগান্তির কথা। তাঁরা বলেন, বাজার করতে গিয়ে পোহাতে হয় বাড়তি ভোগান্তি। ভ্যান নিয়ে সবজি বিক্রেতা এলেও সেখানে মূল্য বেশি। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের জন্য যেতে হয় পাশের এলাকায়। আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানও নেই আবাসিকে। তাই ভবন থেকে যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলছেন বাসিন্দারা। আবাসিকের এফ ব্লকে পার্কের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গার সামনেই আবর্জনার স্তূপ। রাত নামলেই সড়কের পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ দোকানগুলোয় বসে বখাটেদের আড্ডা।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, সড়কগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সড়কের কাজ শেষ করে সিটি করপোরেশনকে আবাসিক এলাকাটি দ্রুত বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কাঁচাবাজার ও পার্কের জন্য আবাসিকে নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে। সেগুলোতেও দ্রুত কাজ সম্পন্ন হবে। কাঁচাবাজারের পাশের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কিছু কাজ হচ্ছে। সেটি শেষ হলেই সেখানে বাজার করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া অবৈধ স্থাপনা দ্রুত উচ্ছেদ করা হবে।
কল্পলোক আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাট মালিক সমবায় সমিতির নেতারা বলেন, আবাসিক এলাকার চারপাশে চলছে উন্নয়নকাজ। কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মাণ করা হচ্ছে সড়ক। এলাকার পাশ দিয়ে যাওয়া খালগুলোয় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় দেওয়া হচ্ছে প্রতিরোধ দেয়াল। এসব উন্নয়নকাজের জন্য আবাসিকের ভেতর দিয়েই চলাচল করে ভারী যানবাহন। এ কারণে দেবে যাচ্ছে সড়কগুলো।
তাঁদের অভিযোগ, কাঁচাবাজারের জন্য বরাদ্দকৃত জায়াগার একাংশ এই প্রকল্পের কাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে, খেলার মাঠ ও কবরস্থানের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গার একাংশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্ল্যান্ট বসানোর জন্য দিয়েছে সিডিএ। এ ছাড়া বিভিন্ন খালি প্লটে অবৈধ দোকান ও ঝুপড়ি নির্মাণ করেছেন কিছু ব্যক্তি। সিডিএকে বিষয়গুলো জানানো হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
নাগরিক সমস্যাগুলো নিয়ে পূর্ব বাকলিয়ার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হারুন উর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সিডিএ থেকে এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। তাই সিটি করপোরেশন থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাচ্ছে না। তবে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কল্পলোকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী পাঠানো হয়। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হলে করপোরেশন থেকে এসব সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক এলাকার কাজ সিডিএ করলেও সড়কবাতি, নালা কিংবা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব করপোরেশনের; যেহেতু গৃহকর নিচ্ছে করপোরেশন। কিন্তু দায়িত্ব বুঝে না পেলে নাগরিক সমস্যা নিয়ে তারা কাজ করতে পারবে না। যেহেতু এটি অনেক পুরোনো প্রকল্প, সুতরাং অধিকাংশ কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। সড়কের কাজ ও আবাসিকের খেলার মাঠ, বাজারসহ অন্যান্য কাজ শেষ করে দ্রুত আবাসিকটি সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। এতে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন বাসিন্দারা।