একনায়কতন্ত্র চলেছে সংবিধানের আড়ালে

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) আয়োজনে ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: সংবিধান প্রসঙ্গ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনেরা। ঢাকা, ৩১ আগস্টছবি: প্রথম আলো

দেশে গত ১৫ বছরে সংবিধানের আড়ালে একনায়কতন্ত্র চলেছে। এক ব্যক্তির হাতে যতক্ষণ পর্যন্ত অসীম ক্ষমতা থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন সম্ভব নয়। বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় একজন সাম্যবাদী মানুষও যদি ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তিনিও এককেন্দ্রিক সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবেন। তাই এই সংবিধান পুনর্লিখনের বিষয়টি ভাবতে হবে।

‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: সংবিধান প্রসঙ্গ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে এসেছে। শনিবার সকালে রাজধানীর পুরোনো এলিফ্যান্ট রোডের একটি মিলনায়তনে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এর আয়োজক ছিল সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।

সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, সংবিধান প্রসঙ্গে আরও আলোচনা হতে হবে। সব শ্রেণির মানুষের বক্তব্য শোনা হবে। একাত্তরের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলেই চব্বিশে (২০২৪ সাল) এই গণ–অভ্যুত্থান। এ ধরনের সংলাপের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দিকে এগোনো যাবে। সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন—কোনটি হবে, সেটি আলোচনার মধ্য দিয়ে ঠিক হবে।

উপদেষ্টা হিসেবে নয়, একজন আইনজীবী হিসেবে সংলাপে বক্তব্য দিচ্ছেন উল্লেখ করে হাসান আরিফ বলেন, অনেকেই বলছেন, এই সরকারকে (অন্তর্বর্তী সরকার) সংবিধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। সরকার সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকারী নয়। এই সরকার হচ্ছে ট্রাস্টি, সুবিধাভোগী হচ্ছে জনগণ এবং এই সরকারের বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থান। সুতরাং এ বিষয়ে (সংবিধান) সিদ্ধান্ত নিতে হলে ছাত্র-জনতার কাছেই ফিরে যেতে হবে। গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনই মূল লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এর আগে সংলাপের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দেশের বর্তমান সংবিধান শেখ হাসিনার হাতে অসীম ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। শেখ হাসিনার জায়গায় যদি আরেকজন আসে, তার হাতেও একই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকবে। একজনের হাতে সব ক্ষমতা থাকার কারণে গত ১৫ বছরে দল এবং সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটি স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল।

সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন কোনটি হবে, সেটি আলোচনার মধ্য দিয়ে ঠিক হবে।
এ এফ হাসান আরিফ, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা

যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে অসীম ক্ষমতা থাকে, তা কমানোর পক্ষে মত দেন তিনি।

শুধু রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়

সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে নাকি সংশোধন করেই এগিয়ে যাওয়া যাবে, এই প্রশ্নের সুরাহা করা গেলে অন্য সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, গণভোটের বিধান ফিরিয়ে এনে অনেক কিছু করা সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকার যদি একটা লক্ষ্য বা রূপরেখা তৈরি করে, তার ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া যেতে পারে।

১৯৭১ সালের আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটাতে চাইলে তা আত্মঘাতী হবে বলে মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। সংবিধান পুনর্লিখন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকেই আছেন, যাঁরা ১৯৭১ সালের আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছেন। সেটা করা যাবে না। ১৯৭১-কে পাশ কাটিয়ে এগোতে চাইলে তা আত্মঘাতী হবে।

যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া উপায় নেই।
আলী রীয়াজ, ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি

সংবিধান প্রসঙ্গে মাহফুজ আলম বলেন, এটা শুধু রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কথা শুনতে হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধান আদর্শিকভাবে একপক্ষীয় ছিল। সেখানে দলের মূলনীতি ও সংবিধানের মূলনীতি এক ছিল। সেই জায়গা কিন্তু এখন নেই। ওই আদর্শিক জায়গাটা পুনর্নির্মাণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আদর্শিক জায়গার এখনো পরিবর্তন হয়নি। তাদেরও সেই জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে।

ভিন্নমতকে আমলে নেওয়ার আহ্বান

সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন প্রসঙ্গে সবার সমান অংশগ্রহণ এবং ভিন্নমতকে আমলে নেওয়ার আহ্বান জানান আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, যাঁরা মনে করেন পুনর্লিখন দরকার নেই, তাঁদেরও মতামত শোনা যেতে পারে। আরও যাঁরা সংবিধানবিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের মতামতও জানা যেতে পারে। তাহলে চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো উঠে আসবে। এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে একটি ব্যাখ্যাও জানা যেতে পারে।

চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, আদিবাসীদের সংবিধানে কী উপায়ে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, সে জন্য পাশের দেশের সংবিধানগুলো বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

কী উপায়ে সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন হবে, সংলাপে সেই প্রশ্ন তোলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন।

১৯৭২ সালের সংবিধান আদর্শিকভাবে একপক্ষীয় ছিল। সেখানে দলের মূলনীতি ও সংবিধানের মূলনীতি এক ছিল।
মাহফুজ আলম, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

একজন ব্যক্তি যদি দলের প্রধান, রাষ্ট্রের প্রধান ও সংসদ নেতা হন, তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে সাম্যবাদী লোকও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবেন বলে মনে করেন নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর।

সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে বক্তব্য দেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, সাবেক বিচারক ইকতেদার আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান, ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দিলরুবা শরমিন প্রমুখ।

আরও পড়ুন