৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ডুবে যেতে পারে ঢাকা শহরের ৮০ ভাগ এলাকা: আইনুন নিশাত

‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি, আমাদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা। রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের সিক্স সিজন হোটেলে, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকা অতিবৃষ্টিতে ডুবে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, ঢাকায় বছরের যেকোনো দিনে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এমনটি হলে এই শহরের ৮০ ভাগ এলাকা ডুবে যেতে পারে।

‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি, আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় আইনুন নিশাত এসব কথা বলেন। সোমবার বিকেলে রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের সিক্স সিজন হোটেলে এই সভার আয়োজন করে গণসাক্ষরতা অভিযান ও নেটজ বাংলাদেশ।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইনুন নিশাত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে সময়মতো বৃষ্টি হবে না উল্লেখ করে আইনুন নিশাত বলেন, এখন বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে বৃষ্টি হয়, আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টি কম হয়।  দুদিন আগে দিল্লিতে ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকাতে ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে অর্ধেক রাস্তা ডুবে যায় এবং আমরা পূর্বাভাস করছি, ঢাকাতে এক দিনে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এমনটি হলে ঢাকা শহরের ৮০ ভাগ এলাকা ডুবে যাবে।

এই জলবায়ুবিশেষজ্ঞ বলেন, ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ঢাকা শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গা, অর্থাৎ এই ভবন (গুলশান-২ নম্বরের সিক্স সিজন হোটেল), এর আশপাশের ভবন ছাড়া সব জায়গাতে পানি উঠবে এবং আমাদের যে প্রতিরক্ষা বাঁধ আছে, সেটাও অকেজো হয়ে যেতে পারে।

অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। লবণাক্ততা ভেতরে ঢুকছে। এখন থেকে ৭০-৮০ বছর পরে যশোর থেকে গোপালগঞ্জ, গোপালগঞ্জ থেকে চাঁদপুর, চাঁদপুর থেকে ফেনী—এর দক্ষিণাংশ সমুদ্রের অংশ হয়ে যাবে। রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জ, তার থেকে আশুগঞ্জ—এই মাঝখানের জায়গাটা লবণাক্ত হয়ে যাবে। ঢাকা শহরের চারপাশে লবণাক্ত পানি থাকবে। ১৫ ফুট উচ্চতার প্রস্তুতি থাকলেও ২০, ২২ বা ২৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এসবের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

চলতি শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লবের আগের তুলনায় দুই ডিগ্রির বেশি বাড়লে বর্তমানে যে প্রজাতির ধান, গম ইত্যাদি হয়, তার উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে, ফুল ফোটার সময় বদলে যাবে। পরাগায়নপ্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। যখন ধান ফলার কথা, তখন না–ও ফলতে পারে। কাজেই এখান থেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়াটা হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি থাকতে হবে উল্লেখ করে আইনুন নিশাত বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাচ্চাদের জন্য ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা পেলে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া সহজ। দুর্যোগ মোকাবিলা সম্পর্কে জ্ঞানও থাকতে হবে। আবহাওয়া পূর্বাভাস দুর্বোধ্য, সেটাকে সহজ করতে হবে। দুর্যোগ বিমা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যানিটেশন ও পানির সুব্যবস্থা থাকতে হবে।

মতবিনিময় সভায় বক্তৃতা করছেন জলবায়ু পরিবর্তন-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত
ছবি: প্রথম আলো

কোন অঞ্চলে কোন ধরনের গাছ লাগাতে হবে—এ বিষয়ে শিশুদের শেখানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, বাচ্চারা সব জায়গায় একই গাছ লাগাবে না। হাওর অঞ্চলে হিজল, সুন্দরবন অঞ্চলে কেওড়া, বাইন ও কড়ই লাগাতে হবে। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তালগাছ লাগানো দরকার।

মতবিনিময় সভায় সঞ্চালক ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী পশুর নদের ‘দুই পাড় ভেঙে যাচ্ছে’ উল্লেখ করে বলেন, নদীর দুই পাড় ভাঙে—আগে এমনটা শোনা যেত না। স্থানীয় বাসিন্দারা এসব বুঝলেও তাঁদের পাত্তা দেওয়া হয় না। প্রাথমিক শিক্ষা বেশি ডিজিটালাইজ করলে সমস্যা হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, ডিজিটালাইজ করতে হলে আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে, শিক্ষকদের তৈরি করতে হবে।

জলবায়ু ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে বলে মনে করেন প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাবিষয়ক সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক মনজুর আহমদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট হলেও এখানে নানা বৈচিত্র্য আছে। হাওর এলাকা, নদীতীরবর্তী এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, পার্বত্য এলাকা, চর—প্রতিটির অবস্থা ভিন্ন। এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনার ব্যবস্থা করতে হবে।

মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন নেটজ বাংলাদেশের পরিচালক শহিদুল ইসলাম, ধরার সদস্যসচিব শরিফ জামিল, গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাশ প্রমুখ।