‘আমি এমনই মা যে গামছা দিয়ে ছেলের হাত-পা বাঁধি’
নতুন নতুন গামছা কিনে রেখেছেন রিনা আকতার। মাঝেমধ্যেই গামছাগুলো দিয়ে তিনি তাঁর অটিস্টিক ছেলে রাইসুল ইসলাম দিনারের হাত-পা বেঁধে রাখেন। তা না হলে ছেলে হঠাৎ রেগে গিয়ে অন্যদের মারধর করে। তখন ওই ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই দিনারকে পাল্টা মারেন। আর সে দৃশ্য সহ্য করতে পারেন না মা।
গতকাল সোমবার রিনা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে আমাকে মারে, তা আমি মেনে নিই। কিন্তু যখন ছেলেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তখন সে হাসপাতালের চিকিৎসক, আনসার সদস্য বা অন্য রোগীদের স্বজন বা সামনে থাকা অন্যদের গায়েও হাত তোলে। মা হয়ে ছেলেকে গামছা দিয়ে যেদিন প্রথম বাঁধি, সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। তারপরও মনে হয়, হাত-পা বাঁধা থাকলে ছেলে কাউকে মারবে না, অন্যরাও আমার ছেলেকে মারতে পারবে না। অন্যরা ছেলেকে মারছে, তা আমি সহ্য করতে পারি না।’
গত সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে রিনা রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ওয়ার্ডে আছেন। আপাতত যক্ষ্মার জন্য তিন মাসের ওষুধের কোর্স শেষ হয়েছে। তবে আরও কত দিন হাসপাতালে থাকতে হবে, তা জানাননি চিকিৎসকেরা।
রিনা আকতারের বিয়ের ১০ বছর পর রাইসুলের জন্ম। ছেলের চার বছর বয়সে তিনি প্রথম জানতে পারেন ছেলে অটিস্টিক, মনোযোগে ঘাটতি ও আচরণে সমস্যা আছে। অটিজমের সঙ্গে চলতি বছরই মানসিক সমস্যা সিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়েছে, এর সঙ্গে যক্ষ্মাও হয়েছে। বিভিন্ন সময় উত্তেজনা ও অতিরিক্ত রেগে যাওয়ার কারণে কখনো ছেলের হাত ভেঙেছে, আবার কখনো পা মচকে গিয়েছে। তখন হাসপাতালই ভরসা।
গত সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে রিনা রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ওয়ার্ডে আছেন। আপাতত যক্ষ্মার জন্য তিন মাসের ওষুধের কোর্স শেষ হয়েছে। তবে আরও কত দিন হাসপাতালে থাকতে হবে, তা জানাননি চিকিৎসকেরা। হাসপাতালের প্রেসিক্রিপশনে রাইসুল অটিজম ও সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বলে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক।
রিনা আকতার বলেন, ‘বলতে গেলে গত ১০ বছর ধরেই কঠিন সংগ্রাম করছি। ঘরের চেয়ে হাসপাতালেই বেশি সময় কাটাতে হচ্ছে। ছেলের দেওয়া আঘাতে আমার সারা শরীরে শুধু জখমের চিহ্ন। গলা টিপে আমাকে উঁচু করে ধরে, তখন দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপরও আমি ছেলেকে আঘাত করি না। আমি তো জানি, ছেলে বুঝেশুনে এসব করছে না।’
‘আমি মা, আমি ছেলের রাগ-ক্ষোভ সব মেনে নিই। কিন্তু বাবা বা অন্যরা তো সব সময় এসব সহ্য করতে পারেন না। তাই অশান্তিও পিছু ছাড়ে না।’
রিনার যখন সাত বছর বয়স, তখন যক্ষ্মায় তাঁর মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেক বিয়ে করেন। বাবা মারা গেছেন পাঁচ বছর হলো। রিনাকে বিয়ের পিঁড়িতে যখন বসতে হয়, তখন তাঁর বয়স ১৪ বছরও হয়নি। অটিস্টিক ছেলের জন্ম দেওয়ায় পরিবার বা স্বজনদের কাছ থেকে তেমন কোনো সহায়তা পাননি রিনা। বরং ছেলে ‘পাগল’, তাকে কেন পাবনার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না, এমন নানা কথা তাঁকে শুনতে হয়।
রিনা বলেন, তাঁর বেঁচে থাকাটা অনেকটা গলায় আটকে যাওয়া মাছের কাঁটার মতো অস্বস্তিকর। কিন্তু ছেলের জন্যই তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। ছেলের এই পৃথিবীতে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই।
রিনার বিবাহিত জীবন ২৪ বছরের। রাইসুলের বাবা রবিউল ইসলাম সরকারি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। রাইসুলের জন্মের পর রিনা জানতে পারেন, তাঁর স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। সে ঘরে তিনটি ছেলেও আছে। দুই পরিবারের খরচ সামলাতে গিয়ে রাইসুলের বাবাকে হিমশিম খেতে হয়।
তা ছাড়া অটিস্টিক ছেলেকে নিয়ে রিনা ও রবিউলের মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। রিনা বলেন, ‘আমি মা, আমি ছেলের রাগ-ক্ষোভ সব মেনে নিই।’
রাইসুল ভাত-মাছের মতো এমন স্বাভাবিক খাবার খেতে পারে না। কেক, জুস, ডাব এমন খাবার খাওয়াতে হয়। এখন শুধু রাতেই ১১টি ওষুধ খাচ্ছে।
রিনা বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি থাকলে খরচ আরও বাড়ে। সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হয় চিকিৎসার খরচ নিয়ে। নিজের গয়না যেটুকু ছিল, তা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। ফেসবুকের একটি গ্রুপের সদস্য, অচেনা কোনো মানুষ বিভিন্ন সময়ই রাইসুলের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। এভাবেই চলছে মা ও ছেলের জীবন।’
রিনা বললেন, ‘আমি কবে একটানা পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছি, তা মনে করতে পারি না। অথচ ছেলেকে বাইরে থেকে দেখলে কিছু বোঝার উপায় নেই। ওর ক্ষতবিক্ষত মনটা শুধু আমি কিছুটা অনুধাবন করতে পারি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, অজ্ঞান পার্টি ছাড়া আমাকে আর কেউ ঘুম পাড়াতে পারবে না। ফিজিওথেরাপি নিচ্ছি। নিজেকেই মাঝেমধ্যে মানসিক রোগী মনে হয়।’
৩৭ বছর বয়সী রিনা পড়াশোনা বেশি দূর করতে পারেননি। এসএসসি পরীক্ষার আগেই বিয়ে হয়। রিনা বলেন, ‘ছেলে সারাক্ষণই বাচ্চাদের মতো খেলনা গাড়ির জন্য জেদ করে। ছেলের চেহারার দিকে তাকালে এত মায়া লাগে। মনে হয়, ছেলেকে অন্যদের মারের হাত থেকে বাঁচাতে যদি শিকল দিয়েও বেঁধে রাখতে হয়, তা–ই করব। তবু তো ছেলে আমার চোখের সামনে থাকবে। ছেলেকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারব না।’
নখ কাটা, গোসল করা, কাপড় পরা্— ধরনের কাজগুলো রাইসুল আগে নিজেই করতে পারত। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ার পর থেকে এগুলো এখন কিছুই করতে চায় না। এমনকি খেতেও চায় না। তাই রিনার সংগ্রামটা আগের চেয়ে আরও বেড়েছে।
রিনা আকতারের বয়স যত বাড়ছে, ততই তিনি ছেলেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন। তাঁর অবর্তমানে ছেলেকে কে দেখবে? রিনা বলেন, ‘ছেলে আমাকে দেখবে, সে প্রত্যাশা কখনোই করিনি বা করার মতো পরিস্থিতিও নেই। শুধু চাই, ছেলে কিছুটা সুস্থ থাক।’
ছেলের রাগ-জেদ-অস্থিরতা দেখে রিনা নিজেকেও অপরাধী ভাবেন মাঝেমধ্যে। বলেন, ‘আমি এমনই মা যে নিজের হাতে গামছা দিয়ে ছেলের হাত-পা বাঁধি। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে।’
রাইসুলের রোগ নিয়ে মনোবিদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অটিজমের পাশাপাশি সিজোফ্রেনিয়া বা অন্য কোনো রোগ হলে তখন পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। এসব ক্ষেত্রে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শও নিতে হবে। একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।
* রাইসুল ইসলামকে সহায়তা করতে চাইলে মা রিনা আকতারের বিকাশ (০১৭৩৯–৩১১৫৪৪) নম্বরে অর্থ পাঠাতে পারেন।