শিশু হাসপাতাল: ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্তানদের চিকিৎসা খরচ মেটাতে চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নারে একটি শয্যায় শুয়ে ছিল এক বছর বয়সী ইয়াসিন। বৃহস্পতিবার থেকে ভর্তি। পাশেই বসে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন তার মা তামান্না। কাছে যেতেই নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। বললেন, একে তো সন্তানের অসুখ, তারপর আবার তার চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের।
শিশু হাসপাতালে সোমবার তামান্নার সঙ্গে কথা হয়। নিম্ন আয়ের পরিবারের এই সদস্য জানান, তাঁর স্বামী কাপড়ের কারখানায় কাজ করেন। আরও একটি সন্তান আছে। তাকে বাসায় রেখে এসেছেন। সোমবারেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ইয়াসিনের জন্য ৪০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে। প্রতিদিনের শয্যা ভাড়া ৭৫০ টাকা। এ ছাড়া ইনজেকশনের খরচও রয়েছে।
একই অবস্থা ১৩ মাস বয়সী শিশু ওয়াজিফার পরিবারেরও। নিউমোনিয়া ও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত বৃহস্পতিবার থেকে হাসপাতালের ডেঙ্গু কর্নারে ভর্তি সে। প্রবল জ্বরের কারণেই হয়তো বারবার কপাল কুঁচকে যাচ্ছিল। তার পাশে বসা মা স্বর্ণা ও দাদি পারভিন। তাঁরা এসেছেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে।
ওয়াজিফার মা ও দাদি বললেন, যাত্রাবাড়ীতে তাঁদের বাসার কাছে মা ও শিশু হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তবে সেখানে জায়গা নেই। তাই শিশু হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন। বেড ভাড়া কত, তা জানেন না। ওষুধ–খাবার সবই কিনতে হচ্ছে। ওয়াজিফার দাদি পারভিন বলেন, ‘বাচ্চাকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে বলেছেন ডাক্তার। ফলের রস দিতে বলেছেন। এত দামের ফল কিনব কীভাবে?’
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নারে বেড ৩৬টি। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার খালি ছিল মাত্র দুটি। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত দুই মাসে হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে ৪০৭টি শিশু। তাদের মধ্যে মারা গেছে দুটি শিশু। আর গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে নয়টি শিশু। হাসাপাতালে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওই মাসে ২ হাজার ৬৬৯ জন আক্রান্ত হন। পরের মাস আগস্টে আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৫২১ জন। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রায় তিন গুণ বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৯৭ জন। চলতি মাসে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৯৮১ জনে। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৫০ জনের। তাঁদের মধ্যে ৩৭টি শিশু।
সন্তানকে নিয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকায়
দুই দিনের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাবে চার বছর বয়সী মীম। হাসপাতালে তার দেখভাল করেছেন ফুফু। তাঁদের বাড়ি কুমিল্লায়। মীমের বাবা কৃষিকাজ করেন। পাঁচ দিন আগে সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে গত শুক্রবার ঢাকায় নিয়ে আসেন। হাসপাতালসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে রাজধানীতে টুকটাক কাজ নিয়েছেন মীমের বাবা।
১১ দিনেও জ্বর ছাড়ছিল না সাড়ে ছয় বছর বয়সী আমেনার। মেয়েকে সুস্থ করতে নোয়াখালী থেকে শিশু হাসপাতালে এসেছেন রহিমা বেগম ও তাঁর স্বামী। এখন অনেকটাই সুস্থ আমেনা। তবে আরও কিছুদিন ভর্তি থাকতে হবে। যাতায়াত, চিকিৎসা, খাওয়াদাওয়া মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তাঁদের খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আরও কিছুদিন থাকতে হলে খরচে কুলাতে পারবেন কি না, এ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন রহিমা বেগম। বললেন, ‘বেডটা বিনা মূল্যে দিলে সুবিধা হতো। ইনজেকশনের দামও বেশি। ফল খাওয়াব কী? একটা পেঁপেই ১২০ টাকা। অন্য ফলের দিকে তাকানোই যায় না।’
চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিন হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়। জ্বর ভালো হলে আরও তিন দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। বমি না হলে, পেটে ব্যথা না থাকলে এবং পরিপাকক্রিয়া স্বাভাবিক হলে তবেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়। প্রতিদিন রোগীপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ ধরলে পাঁচ দিনের খরচ ৭ হাজার ৫০০ টাকা। আর সাত দিনের খরচ ১০ হাজার ৫০০ টাকা।
গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা নিজেদের এক দিনের বেতন দিয়ে ডেঙ্গু ফান্ড তৈরি করেন। খরচ না কুলাতে পেরে কোনো রোগীর অভিভাবক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বিল মওকুফের আবেদন করলে এই ফান্ড থেকে রোগীর পরিবারকে যথাসম্ভব সাহায্য করা হয়।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু কর্নারের ৩৬টি বেডের মধ্যে ২৮টির ভাড়া ৭০০ টাকা। বিনা মূল্যের বেড আটটি। প্রতিদিন ওষুধ, বিছানার ভাড়া, স্যালাইন মিলিয়ে রোগীদের ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো খরচ হয়। শুধু বিনা মূল্যের বেডের রোগীরা স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, খাবার, পানি বিনা মূল্যে পেয়ে থাকে।
মাহমুদুল হক চৌধুরী আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় ডেঙ্গুর বিছানা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। গত বছর শেষ পর্যন্ত আমরা ৬০টি বেড বরাদ্দ দিতে পেরেছিলাম। এবারও সেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এমনটি হলে বিনা মূল্যের বেডের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫টি রাখা হবে।’