খাদ্যের দাম বাড়ায় বেঁচে থাকতে তিন ‘উপায়’

চড়া দামের কারণে মুরগি কিনতে হিমশিম অবস্থা নিম্ন আয়ের মানুষের। মুরগির পা, গিলা-কলিজা, গলা ১৫০ টাকা কেজি দরে কিনছেন এক নারী। গতকাল কারওয়ান বাজারে।
তানভীর আহাম্মেদ

কুড়িগ্রাম সদরের তালকু কালোয়াত গ্রামের দেলোয়ারা বেগম টমেটোর খেতে কাজ করছিলেন। সারা দিন কাজ করে ২০০ টাকা মজুরি পান। দেলোয়ারা বলছিলেন, ‘তিন বেলা ভাত খাই। দিনে লাগে দুই কেজি চাল। আগে ১৭০ টাকা পেতাম। তাতেও কোনোমতে পাঁচজনের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়া যেত। এখন ভাত-আলু আর সবজির দুইটা পাতা দিয়ে রান্না করে কোনোমতে চলে।’ শেষ কবে মাছ-মাংস খেয়েছেন, ভুলে গেছেন দেলোয়ারা। হতাশার সুরে বললেন, ‘আপনারা যদি কোরবানির ঈদে কিছু মাংস দেন, তাহলে খাইতে পারব।’

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২২–এর জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষের আয়-ব্যয় নিয়ে জরিপ করেছে। এতে তাদের খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা বাবদ খরচের তথ্য উঠে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে চাল ও আটার দাম কমেছে। তবে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বেড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে। তবে এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে দেশের অর্ধেকের (৫৩ শতাংশ) বেশি মানুষ। খাদ্যের দাম বাড়ায় তারা তাদের জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচ কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

আরও পড়ুন
নিম্নমধ্যবিত্তদেরও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। কারণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তারাও বড় বিপদে পড়েছে। সেটা ওএমএসের লাইনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

জরিপে দেখা গেছে, একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটা খাবার দরকার, তার দাম এক বছরে ১২ শতাংশ বেড়েছে। আর গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে, অর্থাৎ এক মাসে বেড়েছে ৪ শতাংশ। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার কেনা বাবদ মাসে মাথাপিছু খরচ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৩৯ টাকা, যা উপার্জন করা গরিবের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

গত সপ্তাহে প্রকাশ করা ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য ৬৮ শতাংশ মানুষের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়। খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের দাম এক বছরে বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর কোভিড সংক্রমণের আগের সময় অর্থাৎ ২০২০–এর মার্চের আগের তুলনায় বেড়েছে ৬১ শতাংশ।

আরও পড়ুন

টিকে থাকার তিন ‘উপায়’

প্রতিবেদনে বলা হয়, যে ৫৩ শতাংশ মানুষ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে জীবনযাপন ও খাদ্য বাবদ খরচ কমিয়েছে, তারা টিকে থাকতে তিনটি উপায় বেছে নিয়েছে। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ পরিবার বাকিতে খাবার কিনছে। ৫৩ শতাংশ ঋণ করছে, ১৫ শতাংশ তাদের সঞ্চয় বা জমানো টাকা ভেঙে প্রতিদিনের খরচের জোগান দিচ্ছে। বাকি ৪ শতাংশ পরিবার জমি বিক্রি করছে বা অন্যত্র চলে গিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সার্বিকভাবে মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাচ্ছে।

খাদ্য নিয়ে চাপে থাকা পরিবারগুলো যতটুকু বাজারসদাই করতে পারছে, তা প্রথমে ঘরের শিশুকে খাওয়াচ্ছে। পরিবারের অন্যরা কম খাবার খাচ্ছে। বিশেষ করে মাছ, মুরগি, ডিম ও ভোজ্যতেলের মতো খাবার খাওয়া তারা কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে তাদের পুষ্টির সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত ও অন্যান্য বিনোদন বাবদ খরচ কমিয়ে দেওয়ায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আরও পড়ুন

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র মানুষের আমিষের প্রধান উৎস ছিল ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও ডাল। আর ভোজ্যতেল হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্যের অন্যতম উৎস। গত এক বছরে ওই সব কটি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো ন্যূনতম আমিষের চাহিদা মেটাতে পারছে না।

তবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুত আছে। রমজান মাসে আমরা এক কোটির ওপরে পরিবারকে মাসে বিনা মূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেব। আগামী মাস থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু করা হবে। এ ছাড়া ওএমএসের আওতা এবং ট্রাকপ্রতি খাদ্যের পরিমাণও বাড়ানো হবে। ফলে আশা করি, খাদ্য নিয়ে যে সমস্যা চলছে, তা আর থাকবে না।’

আরও পড়ুন

খাবার কিনতে হিমশিম কৃষিমজুরদের

দেশের নিম্ন আয়ের মানুষদের আয়-ব্যয় নিয়ে প্রথম আলো ঢাকার সাভার, নীলফামারীর সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ও পটুয়াখালীর ২২ জন দিনমজুরের সঙ্গে কথা বলেছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে একজন নারী শ্রমিক দিনে ২০০ টাকা, পুরুষ শ্রমিক ৪০০ টাকা, নীলফামারী সদরে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, পটুয়াখালীতে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা এবং ঢাকায় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে মজুরি পান।

নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন ঢাকা ও কক্সবাজারের অধিবাসীরা। গত জানুয়ারিতে বিশ্ববাজার এবং দেশে চাল ও আটার দাম কিছুটা কমেছে। এর প্রভাবে সারা দেশে ওই পণ্যগুলোর দাম কমবেশি কমেছে। যেমন চালের দাম কেজিতে গড়পড়তায় ৫২ টাকা থেকে কমে জানুয়ারিতে ৪৮ টাকা হয়েছে। আর আটার কেজি ৬৮ টাকা থেকে কমে ৬৬ টাকা হয়েছে। কিন্তু ঢাকা ও কক্সবাজারে ওই খাদ্যপণ্যগুলোর দাম কমেনি। উল্টো ৫ শতাংশ বেড়েছে। ফলে এখানকার দরিদ্র পরিবারগুলো আরও বেশি চাপে পড়েছে।

খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও বাংলাদেশের দিনমজুরদের আয় গত এক বছরে কমেছে। এই তথ্য উল্লেখ করে জাতিসংঘের আওতাভুক্ত ওই সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি তথ্যকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাতে দেখা যায়, ওই সময়ে (২০২২ এর নভেম্বর) দেশের একজন কৃষিমজুরের এক দিনের আয় ছিল ৫৩১ টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দেড় শতাংশ কম। ওই অর্থ দিয়ে একজন দিনমজুর ১১ কেজি ৩০০ গ্রাম চাল কিনতে পারতেন। বর্তমান আয় দিয়ে তাঁরা এর চেয়ে কম চাল কিনতে পারছেন বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর মধ্যে ঢাকার সাভারের কৃষিমজুরেরা মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে কিনছেন। কুড়িগ্রামে তা ৫০ টাকা, দিনাজপুরে ৪৮ টাকা এবং পটুয়াখালীতে ৫০ টাকা। এসব এলাকার ১২ জন কৃষিশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের চাল, আলু, সবজি, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল কিনতে আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।

নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধি এম আর আলম জানান, খাদ্যের দাম বাড়ায় সেখানকার বেশির ভাগ গ্রামে কৃষিমজুরেরা আগের চেয়ে কম খাবার কিনতে পারছেন।

সৈয়দপুরের বোতলগাড়ি ইউনিয়নের মিস্ত্রিপাড়ার বর্গাচাষি সঞ্জীব কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, দিনে তাঁর আয় ১০০ টাকা বাড়লেও খরচ দেড় শ টাকা বেড়েছে। ফলে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মেলাতে পারছেন না। পুরোনো ঋণের কিস্তির টাকা শোধ করতে হচ্ছে, আবার প্রতি মাসে নতুন করে ঋণ করতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে গলা পর্যন্ত ঋণ হয়ে যাচ্ছে।

চোখধাঁধানো অবকাঠামোর চেয়ে কর্মসংস্থান গুরুত্বপূর্ণ

প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গম, ভোজ্যতেল ও ডালের মতো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে কোভিডের প্রভাব এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় চালের প্রায় পুরোটা দেশে উৎপাদিত হয়। এই তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণত আমন ধান ওঠার পর বাংলাদেশে চালের দাম কমে। কিন্তু চালের দাম সেই অনুপাতে কমেনি। কারণ, সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।

ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চোখধাঁধানো বড় বড় প্রকল্পের দিকে নজর না দিয়ে সরকারের উচিত দেশের গরিব মানুষের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এ জন্য তাদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ বেশি নিতে হবে। নিম্নমধ্যবিত্তদেরও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। কারণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তারাও বড় বিপদে পড়েছে। সেটা ওএমএসের লাইনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য সহায়তা দিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জহির রায়হান ও সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান]