রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা প্রয়োজন বলে মনে করে টিআইবি

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ‘নতুন বাংলাদেশ: কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী ১০০ দিনের ওপর টিআইবির পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে। আজ সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়েছবি: আশরাফুল আলম

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনেক ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের অ্যাডহক (অস্থায়ী) প্রবণতা লক্ষণীয়। রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত অর্জনের লক্ষ্যে সরকারের একটি রোডম্যাপ (রূপরেখা) ঘোষণা করা প্রয়োজন। তাঁরা শুরুতেই এটি করার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো করা হয়নি। তবে তা করার সময় এখনো আছে।

আজ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ইফতেখারুজ্জামান এ কথাগুলো বলেন। ‘নতুন বাংলাদেশ: কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী ১০০ দিনের ওপর টিআইবির পর্যবেক্ষণ’ তুলে ধরতে রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে সংস্থাটির কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার, অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন খাতে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে টিআইবি।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু একটি সরকার পরিবর্তনের জন্য ছাত্র আন্দোলন হয়নি। আন্দোলনটা হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য, নতুন বাংলাদেশের জন্য। সেটা করতে কতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে। এই কমিশনগুলোর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাস্তব রাষ্ট্র সংস্কার না করে অন্তত এগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সৃষ্টির মতো জায়গায় না গিয়ে চট করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্তরায় থেকে যাবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের কার্যক্রম প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যদিকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, যা স্বাভাবিক। যেকোনো দেশে এমন বিশাল জঞ্জাল কাটিয়ে উঠে নতুন সংস্কারের পথে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেশে সংস্কারের যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সবই সমাধানযোগ্য।

ইফতেখারুজ্জামান উল্লেখ করেন, টিআইবি গত ৯ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল, যেন রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত অর্জনের লক্ষ্যে একটি সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ৯ তারিখে (আগস্ট) দাবি ছিল, সরকারের উচিত হবে অর্পিত দায়িত্ব নিজেরা বিশ্লেষণ করে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার পর একটা কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করা। সেটা করতে পারলে তার মধ্যে রোডম্যাপ থাকত। এটা নেই। এটা এখনো পরিষ্কার নয়। এটি অপরিহার্য বলে মনে করছেন তিনি। এটা করার এখনো সময় আছে। আল-জাজিরাকে যেভাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সেটা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে। তাদের কৌশলপত্র প্রণয়ন, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রকাশ করার এখনো সময় আছে বলে তিনি মনে করেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের কার্যক্রম প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যদিকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, যা স্বাভাবিক। যেকোনো দেশে এমন বিশাল জঞ্জাল কাটিয়ে উঠে নতুন সংস্কারের পথে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেশে সংস্কারের যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সবই সমাধানযোগ্য।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু একটি সরকার পরিবর্তনের জন্য ছাত্র আন্দোলন হয়নি। আন্দোলনটা হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য, নতুন বাংলাদেশের জন্য। সেটা করতে কতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে। এই কমিশনগুলোর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাস্তব রাষ্ট্র সংস্কার না করে অন্তত এগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সৃষ্টির মতো জায়গায় না গিয়ে চট করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্তরায় থেকে যাবে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারই বলতে পারবে, এটি করতে কত সময় লাগবে। সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হলে দেশবাসী একটি নির্দেশনা পাবে। যাদের মধ্যে অস্থিরতা আছে, নির্বাচন কবে হবে, কিছু মৌলিক প্রশ্ন—এগুলোর উত্তর সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া সম্ভব, দেওয়া উচিত।

সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যক্রম নিয়েও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। পরিবর্তনের পথে ভারতের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আশা করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টিআইবি মনে করছে, ভারত তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক, কূটনীতিক ও কৌশলগত পরাজয় স্বীকার করে নিতে পারছে না। সেই সৎ সাহস তাদের নেই। যে কারণে তাদের কাছ থেকে যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশা ছিল, সেটা তারা করতে পারছে না। তারা এখনো কর্তৃত্ববাদের সমর্থনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশকে দেখছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ইতিবাচক রাজনৈতিক চর্চার ঘাটতি দৃশ্যমান। দলবাজি, দখলবাজি ও চাঁদাবাজি নতুন করে চলছে। এটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আলোচনার বাইরে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক দল। তাদের চর্চায় যদি গণতন্ত্র না থাকে, বৈষম্যবিরোধী চেতনা না থাকে, আন্দোলনের চেতনার প্রতিফলন না হয়, তাহলে রাষ্ট্র সংস্কারের যত কথাই বলা হচ্ছে, সংস্কার প্রতিবেদনগুলো শুধু কাগজে দলিল হয়ে থাকবে।

সরকারের ১০০ দিন নিয়ে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে একটি গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। গবেষণার প্রধান গবেষক শাহজাদা এম আকরাম প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন। এতে বলা হয়, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা বা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিতর্কিত হয়েছে। আটটি জাতীয় দিবস পালন না করার সিদ্ধান্ত সমালোচিত হয়েছে। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানে কোথাও কোথাও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। কিসের ভিত্তিতে চুক্তিতে নিয়োগ, তা পরিষ্কার নয়। নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ক্ষেত্রবিশেষে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড ও স্বচ্ছতার অনুপস্থিতি দেখা গেছে। রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া বা না-দেওয়ার চর্চা অব্যাহত রয়েছে।

প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর সারা দেশে ছয় শতাধিক নিহত ও ১০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী, প্রান্তিক ও ভিন্নমতের জনগোষ্ঠীর আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ঘটনা যাচাই করা, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, তদন্ত করা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি দেখা গেছে।

বিএনপির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, দলটির ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা ও প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক উদ্যোগের অনুপস্থিতি রয়েছে। দলের মধ্যে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি বিদ্যমান।

আওয়ামী লীগের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থ পাচার, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন, বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার বা কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেনি দলটি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বেড়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিতর্কিত ভূমিকা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিনিধিত্বশীল না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতের সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি।