দেশে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের প্রায় ১ কোটি রোগী রয়েছে।
দেশে প্রতিবছর ২০ হাজার মানুষ এ দুটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন।
দেশে প্রায় সব রোগের আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। পাওয়া যায় ওষুধপত্রও। তবে যে রোগটি নির্ণয় ও এর চিকিৎসার জন্য মানুষকে এখনো বিভাগীয় বা বড় শহরে যেতে হয়, সেটি হলো হেপাটাইটিস। এর চিকিৎসা ব্যয়ও সবার সাধ্যের মধ্যে নেই। রোগটির চিকিৎসায় দেশে নেই কোনো রোডম্যাপ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) হেপাটাইটিসের চিকিৎসাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসুবিধার আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। সংস্থাটি এ সেবাকে কমিউনিটির কাছাকাছি বা মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে; যাতে করে যাঁর যে ধরনের হেপাটাইটিসই থাকুক না কেন, তিনি যেন সঠিক চিকিৎসা সহজেই পেতে পারেন।
এমন পটভূমিতে আজ ২৮ জুলাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য—হেপাটাইটিস নির্মূলের এখনই সময়।
দেশে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসের প্রায় ১ কোটি রোগী আছেন। তাঁদের মধ্যে বি ভাইরাসধারী আছেন ৮৫ লাখ; অন্যরা সি ভাইরাসে আক্রান্ত।
হেপাটোলজি সোসাইটি ঢাকা, বাংলাদেশ–এর সাধারণ সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহিনুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা ও কমিউনিটি পর্যায় থেকেই হেপাটাইটিসের চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন। দেশে এখনো রেফারেল পদ্ধতি তৈরি হয়নি। অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে এ রোগনির্ণয় হবে ও সেখানে ক্ল্যাসিফিকেশন বা কোন ভাইরাসে আক্রান্ত, তা নির্ধারণ করতে হবে। যাঁদের দ্রুত বা উন্নত চিকিৎসা দরকার, তাঁদের জেলা বা বিভাগীয় শহরে পাঠাতে হবে। দেশে এসব সুবিধা নেই।
কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হেপাটাইটিস বি ও সি চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে অধ্যাপক শাহিনুল বলেন, এ জন্য একটি রোডম্যাপ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে সেভাবেই চিকিৎসা হয়।
লিভার ক্যানসার ও সিরোসিসের প্রধান কারণ হচ্ছে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। বিশ্বে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতি ১০ জনের ৯ জন জানেনই না, তাঁরা হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মারা যাচ্ছেন। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর হেপাটাইটিস বি এবং সিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন ২০ হাজার মানুষ।
এ ভাইরাস দুটি অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, দূষিত রক্ত গ্রহণ, দূষিত সুই, রেজর, ক্ষুর ও ব্লেডের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সম্পর্কে এবং জন্মের সময় মা থেকে সন্তানের মধ্যেও এর সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
রোগটি নির্ণয় ও এর চিকিৎসার জন্য মানুষকে এখনো বিভাগীয় বা বড় শহরে যেতে হয়। চিকিৎসা ব্যয়ও সবার সাধ্যের মধ্যে নয়।
দেশে লিভার প্রতিস্থাপন বাদে হেপাটাইটিসের সব চিকিৎসাই হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন, হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের জন্য ৮৪ দিনের চিকিৎসা নিতে হয়। এ জন্য এক কোর্স বা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার ব্যয় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের জন্য প্রতিদিন একটি ওষুধ খেতে হয়। যার দাম ৪০ থেকে ১৫০ টাকা। তবে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত সবাইকে ওষুধ খেতে হয় না। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি হলে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসের ওষুধগুলো জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ঘোষণা করে ট্যাক্স কমানো দরকার। এতে ব্যয় কিছুটা কমবে।
২০০৫ সাল থেকে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি চালু করেছে সরকার। ফলে সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। পূর্ণবয়স্ক মানুষের সংক্রমণ চার ভাগের এক ভাগে ও শিশুদের তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিসে সংক্রমণ ৯০ শতাংশ ও মৃত্যু ৬৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে।
জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এসডিজির লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে এখনই কৌশলগত পরিকল্পনা নিতে হবে এবং মানুষকে তা জানাতে হবে। সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে এ কৌশল ঠিক করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। হেপাটাইটিসের চিকিৎসা ও প্রতিকার সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। তাই উপজেলা পর্যায়ে যেন এ কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়, সে উদ্যোগ নিতে হবে।