কামরুদ্দীন আহমদ
বন্দিদশা থেকে মুক্তি
পাকিস্তানের নৃশংস সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে একাত্তরের এই দিনে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের বুকে ছিল মৃত্যুকে উপেক্ষা করার সাহস, অন্তরে মুক্তির স্বপ্ন। স্বাধীন দেশে বারবার পরাহত হয়েছে সেই স্বপ্ন। খোলা চোখে মুক্তিযুদ্ধের অবলোকন নিয়ে এই লেখা।
ইয়াহিয়া খানের বন্দিদশা কাটিয়ে যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে এলাম, তখন বাইরে এসে যে বাংলাদেশকে দেখলাম, সে বাংলা আমার কাছে নতুন বাংলাদেশ। হাজার হাজার যুবকের আনন্দ-উল্লাসে মুখর বাংলা। তাদের হাতে এমন সব আগ্নেয়াস্ত্র, যা আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। তাদের নিকট গুলি-বারুদও অফুরন্ত। আমি প্রথম দিকে একটু ভীত হয়ে পড়লাম, রাস্তার ওপারে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, এই বুঝি গুলি এসে লাগল। রাস্তা অতিক্রম করে হাঁপিয়ে গেলাম। বাড়ি থেকে গাড়ি আসেনি। খুব একটা আশাও করিনি। জেলগেট পৌঁছার আগে অবশ্য আশা করেছিলাম যে আমার ছোট ছেলে আজাদ যদি মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে থাকে, তবে নিশ্চয়ই আমাকে স্বাগত জানাতে গাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু গেটের বাইরে এসে যখন তাকে দেখলাম না, তখন কেন যেন মনে হলো হয়তোবা আজাদ হারিয়ে গেছে চিরতরে।
দাঁড়িয়ে ভাববার সময় নেই। কারণ, হাজার কয়েক কয়েদি তাদের জেলের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে যার যেদিকে খুশি। বোধ হয় অন্তরে তাদের তখনো ভয়, যদি আবার তাদের আটক করা হয়। নিরাপত্তা–বন্দীদের ঘরে ঢুকে তাদের জামাকাপড়, বিছানাপত্তর, জুতা-মোজা, বাড়ি থেকে আনা নানা প্রকার খাবার–বস্তু যে যা হাতের কাছে পেয়েছে লুট করছে। জেলের কর্মচারীরা কোথাও লুকিয়েছে, সিপাহিরা প্রাণভয়ে কোথাও পালিয়ে গেছে। পাগলাগারদের দরজা খুলে পাগলরাও বেরিয়ে এসেছে। বাইরে এসেই আবার জেলের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করছে।
রাজাকাররা পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের রাইফেলগুলো রাস্তার দুই পাশে ড্রেনে ফেলে গেছে, আর চোর-ডাকাত প্রভৃতি সদ্যমুক্ত দুর্ধর্ষ কয়েদিরা তা তুলে নিচ্ছে তাদের হাতে; বোধ হয় ভবিষ্যতে কাজে লাগাবার জন্য। দেশে যখন সরকার নেই, তখন ওইভাবে জেলগেট খুলে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও নীতিজ্ঞানশূন্য অপরাধীদের মুক্ত করে দেওয়া আর দেশকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেওয়া একই কথা। সাজা খেটে যখন তারা দেশে যায়, তখন জেলখানা থেকে তাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা খরচ দিয়ে দেওয়া হয়। এবার যারা বেরিয়ে এল, তাদের কারও কাছে কোনো টাকাপয়সা না থাকারই কথা। সুতরাং সেই রাতেই খালি বাড়ি লুট করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না। এক ঢাকা কেন্দ্রীয় জেল থেকেই বেরিয়ে গেল সাড়ে চার হাজার কয়েদি। পরবর্তীকালে ওই অপরাধীদের সংঘবদ্ধ দলগুলোর কার্যকলাপ মুজিব বাহিনীর চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করেছিল।
বাড়ি ফেরার পথে দুই পাশের বাড়িগুলোর ওপর দেখলাম ঝান্ডা উড়ছে। ৯ মাস আগে স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়, বিশেষ করে ২৩ মার্চ যে ঝান্ডা প্রথম ওড়ানো হয়েছিল, সে ঝান্ডাই ওড়ানো হয়েছে। ভাবলাম, কোথায় পেল এরা দুই দিনের মধ্যে এত পতাকা। এও কি সম্ভব যে পতাকাগুলো তৈরি হয়েছিল ঘরে ঘরে ওই ৯ মাস ধরেই, যেগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল দীর্ঘ ৯ মাস; ধরা পড়লে অনিবার্য মৃত্যু জেনেও। যেসব বাড়ির গেটে উর্দু নামফলক ছিল বা আরবিতে আল্লাহ-মুহাম্মদ বা কালেমা লেখা ছিল, তা দেখলাম বাড়ির লোকেরা বেরিয়ে এসে সরিয়ে নিচ্ছিল আর তার পরিবর্তে পুরান বাংলায় নামফলক লাগিয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা শহরের চেহারাই বদলে গেছে বলে মনে হলো। যে ঢাকা আমি জন্মাবধি দেখেছি, এ যেন সে ঢাকা নয়। পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির পরিবর্তে রিকশা হয়েছিল, কুর্তা-পায়জামার পরিবর্তে প্যান্ট-শার্টের প্রচলন হয়েছিল, আর অনেক ইটের খোলার রাস্তা পিচ দেওয়া রাস্তায় পরিবর্তিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে কিছু ট্যাক্সি, কিছু বাস ও কিছু প্রাইভেট কারও এসেছিল। কিন্তু সে পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল বলে মনে হয়েছে। এবারের পরিবর্তন কিন্তু একেবারে আলাদা। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান–সংলগ্ন ট্রাইবাল অঞ্চলে অনেকের হাতেই বন্দুক দেখলেও অস্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় হাজার হাজার ছেলের হাতে নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র অস্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে আদেশ দেওয়ার যেমন কেউ নেই, তেমনি আদেশ মেনে নেওয়ারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন ধরনের অরাজকতা বর্তমান শতাব্দীতেও এসেছে। যেমন সাইপ্রাস থেকে ব্রিটিশ সরকার দেশটা চালাবার কোনো ব্যবস্থা না করেই যখন প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত তাদের লোকজন তুলে নিয়ে গেল, তখন তার ফলে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও সাইপ্রাসবাসীরা ভোলেনি। এমন কোনো বাড়ি ছিল না, যে বাড়ি লুণ্ঠিত হয়নি, এমন কোনো মহিলা ছিল না যার ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়নি। ব্রিটিশ যখন একইভাবে প্যালেস্টাইন ছেড়ে গিয়েছিল বা ফরাসিরা যখন আলজেরিয়া ছেড়ে এসেছিল, তখনো অতখানি না হলেও সেখানকার মানুষগুলো প্রায় পশুর পর্যায়ে নেমে এসেছিল। যেমন হয়েছিল ১৯৪৬-৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজের যাওয়ার প্রাক্কালে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে। হাজার হাজার মেয়েদের উদ্ধার করেছিলেন মৃদুলা সারাভাই পশ্চিম ও পূর্ব পাঞ্জাব থেকে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেও ওই উদ্ধারকাজ চলছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে যখন কোনো সরকারের অস্তিত্ব ছিল না, তখনো মুক্তিবাহিনীর লোক ওই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করেছে বলে আমি শুনতে পাইনি। মুক্তিবাহিনীর হাতে রাজাকাররা খুন হয়েছে, কিন্তু তাদের স্ত্রী-কন্যাকে কেউ ধর্ষণ করেছে, এমন উদাহরণ নেই।
সূত্র: স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, কামরুদ্দীন আহমদ, প্রথমা প্রকাশন, ২০২৪
কামরুদ্দীন আহমদ: প্রয়াত রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক