আশ্রয়শিবির
রোহিঙ্গাদের শুধু টেলিটকের সিম দেওয়ার চিন্তা
রোহিঙ্গারা বৈধভাবে সিম কিনতে পারে না। তারা বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে কেনা সিম ও মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের শুধু সরকারি মোবাইল অপারেটর টেলিটকের সিম দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। এখন রোহিঙ্গারা বৈধভাবে কোনো সিম কিনতে পারে না। তবে তারা স্থানীয় বাংলাদেশিদের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিপরীতে কেনা সিম ব্যবহার করে, যা বৈধ নয়।
রোহিঙ্গাদের মধে৵ অনেকে মিয়ানমারের মোবাইল অপারেটরের সিমও ব্যবহার করে। সীমান্তে বাংলাদেশের ভেতরে মিয়ানমারের মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় বলে রোহিঙ্গারা এই সুযোগ পায়।
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির কেন্দ্রিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অবৈধভাবে দেশি অপারেটরের সিম ব্যবহার করে এবং মিয়ানমারের সিম ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। এই অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনতে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেকোনো একটি মোবাইল অপারেটরের সিম রোহিঙ্গাদের কেনার সুযোগ দেওয়ার চিন্তা চলছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উদ্যোগে ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের কাছে মোবাইল ফোনের সিম বিক্রি-সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি’ নামের একটি গঠিত হয়েছে। এ কমিটি গত ২০ মার্চ তাদের প্রথম সভা করে। সভায় রোহিঙ্গাদের কাছে টেলিটকের সিম বিক্রি করার বিষয়ে সুপারিশ করা যেতে পারে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোস্তফা জামান। এতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টেলিটক, নাকি অন্য কোনো অপারেটর থাকবে, সে বিষয়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মিয়ানমারে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া সেনা অভিযানের পরের পাঁচ মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর আগে থেকেই আছে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। এখন পুরোনো, নতুন এবং আশ্রয়শিবিরে জন্ম নেওয়া শিশু মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয়। এই সন্ত্রাসীরা মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে নিয়মিত খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে।
রোহিঙ্গাদের কাছে সিম (গ্রাহক শনাক্তকরণ নম্বর) বিক্রির বিষয়ে সুপারিশ দিতে গঠিত কমিটির প্রথম সভার কার্যবিবরণী থেকে সভায় কী কী আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়। সভায় বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দু-তিনটি অপারেটরের সিম ব্যবহার করে।
ভিনদেশি মুঠোফোন অপারেটরের সিম ব্যবহারের কারণে তাদের গতিবিধি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য। তাই তাদের বৈধভাবে বাংলাদেশি অপারেটরের আওতায় আনা এবং মিয়ানমারের সিম ব্যবহার বন্ধ রাখা আবশ্যক। সভায় রোহিঙ্গাদের যেকোনো একটি মোবাইল অপারেটরের আওতার মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মত দেন কেউ কেউ। সেই ‘একটি’ অপারেটর হিসেবে টেলিটকের নামই উঠে আসে এবং টেলিটকের কাছে তাদের কারগরি বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
জানতে চাইলে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম হাবিবুর রহমান গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, কমিটি থেকে তাঁদের কাছে টেলিটকের সক্ষমতার বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়েছিল। তাঁরা সেই প্রতিবেদন দিয়েছেন।
কমিটির আলোচনায় বলা হয়, রোহিঙ্গারা যেসব সিম ব্যবহার করে, সেগুলো বাতিল করে তাদের ফ্যামিলি কাউন্টিং নম্বর (এফসিএন) কার্ডের বিপরীতে সিম বিক্রি করা যেতে পারে। পরিবারপ্রতি একটি সিম বরাদ্দ দেওয়ার কথাও আলোচনায় উঠে আসে।
বিষয়টি নিয়ে মতামত জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ বিষয়ে আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, টেলিযোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের গতিবিধি বৈধভাবে নজরদারির সুযোগ রয়েছে। এই দায়িত্ব সেই সব অপারেটরের হাতে থাকা উচিত, যারা এ বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। টেলিটকের সেই সক্ষমতা নেই। সব অপারেটরের সেখানে সিম বিক্রির সুযোগ থাকা উচিত।
রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে মিয়ানমারের মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক পাওয়ার বিষয়টিও আলোচনা হয় কমিটির সভায়। এতে একটি সংস্থার একজন প্রতিনিধি বলেন, সীমান্তে জ্যামার বসিয়ে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক দুর্বল করা যায়। তবে সেটি অনেক ব্যয়বহুল হবে। দরকার হবে প্রায় ১ হাজার ১০০টি জ্যামার। প্রতিটির দাম আনুমানিক দুই কোটি টাকা ধরে ব্যয় হবে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নেটওয়ার্কজনিত যে সমস্যা রয়েছে, সেটি একসময় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তেও ছিল বলে জানান লার্নএশিয়ার আবু সাঈদ খান। তিনি জানান, বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত। চোরাচালানিরা এর অপব্যবহার করত। ২০১০ সালের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সফলভাবে বিষয়টি সমাধান করে।
আবু সাঈদ খান বলেন, ভারতের সঙ্গে সমস্যাটির সমাধানে নিরাপত্তা বাহিনী ও আমলাতন্ত্রে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সমস্যাটির ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত নেওয়া এবং এ প্রক্রিয়ায় তাঁদের যুক্ত করা উচিত।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কের সমস্যা সমাধানে দেশটির সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন আবু সাঈদ খান। তিনি বলেন, মিয়ানমারের বাংলাদেশঘেষাঁ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। সেখানে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে বিপুল ব্যয়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল রাখার পেছনে দেশটির দুর্নীতিবাজ সেনা কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন।
বাংলাদেশের ভেতরে মিয়ানমারের মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক পাওয়া এ দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করে আবু সাঈদ খান বলেন, বিষয়টি মিয়ানমার সরকারের কাছে যেমন তুলে ধরতে হবে, তেমনটি দেশটির মিত্র দেশগুলোকেও জানাতে হবে, যারা বাংলাদেশেরও বন্ধু।