সরকারি প্রকল্পের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে আসন পেতে মায়েদের ছোটাছুটি
সালেহা আক্তার (২৮) রাজধানীর গ্রিন লাইফ নার্সিং কলেজে শিক্ষকতা করছেন। দ্বিতীয় সন্তানের বয়স দুই মাস। তাঁর প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস। চার বছর বয়সী বড় সন্তানকে সরকারের ‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের ‘পানি ভবন’ কেন্দ্রে রাখতে পেরেছেন। কেন্দ্রে দ্বিতীয় সন্তানের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত আসন পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা পাননি।
মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে আর দুই মাস পর কী হবে, সেটি ভেবে দুশ্চিন্তায় অস্থির রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার এই বাসিন্দা। পানি ভবন কেন্দ্র থেকে তাঁকে জানানো হয়েছে, তিনি ১৫০ জনের সঙ্গে অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছেন।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ের ‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের আওতাধীন কেন্দ্রগুলোতে আসন পেতে অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে ৩৯১টি আবেদন। ৩৫৩টি আবেদনই রাজধানীর সাতটি কেন্দ্রের। রাজস্ব বাজেটে পরিচালিত সরকারি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের (৪৩টি) সেবার মান ও নিরাপত্তা নিয়ে যেখানে এন্তার অভিযোগ, সেখানে প্রকল্পের আওতায় তুলনামূলক উন্নত মানের এই ২০টি কেন্দ্রে সন্তানদের জন্য আসন পেতে মা-বাবাকে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে।
ঢাকায় আরও বেশি কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। আর ঢাকার বাইরের কেন্দ্রগুলো যেসব জায়গায় করা দরকার ছিল, সেসব জায়গায় প্রয়োজনীয় স্থান পাওয়া যায়নি। সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর আঙিনায় অবকাঠামো করে কম খরচে উন্নত মানের দিবাযত্ন কেন্দ্র করা সম্ভব। এতে কর্মজীবী নারীরা উপকৃত হতেন।শবনম মোস্তারী, প্রকল্প পরিচালক
সালেহা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রকৌশলী স্বামীর অফিসেও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র নেই। শাশুড়িকে ঢাকায় এসে থাকার অনুরোধ করবেন বলে ভাবছেন। কিন্তু শাশুড়ি রাজি না হলে কী করবেন, সেটি ভেবে তাঁর দুশ্চিন্তা বাড়ছেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের একজন নারী নির্বাহী প্রকৌশলী (৩৩) প্রথম আলোকে বলেন, সন্তানকে একটি ভালো দিবাযত্ন কেন্দ্রে রাখতে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন, সেটিকে দুশ্চিন্তা বললে কম হবে। প্রতিদিন মনে হতো, এক নারী সহকর্মীর মতো তিনিও চাকরি ছেড়ে দেবেন।
এই নারী প্রকৌশলী আরও বলেন, তাঁর সন্তানের বয়স আট মাস। এটাই প্রথম সন্তান। মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি শেষ হওয়ার পর তিনি আরও ১৫ দিন ছুটি নেন। দেড় মাস ধরে তিনি সন্তানকে নিয়েই অফিস করছেন। তবে পাঁচ মাস অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকার পর জানুয়ারি থেকে তিনি ‘পানি ভবন’ কেন্দ্রে আসন পেয়েছেন।
কেন্দ্রগুলোর মাসিক সেবামূল্য সর্বনিম্ন এক হাজার, সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা। তবে বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থাও রয়েছে। অভিভাবকের মাসিক আয় ৮ হাজার, ২০ হাজার, ৩৫ হাজার ও ৫০ হাজার টাকার নিচে হলে শিশুকে মাসে যথাক্রমে ১০০, ২০০, ৪০০ ও ৬০০ টাকায় রাখা যায়। কোনো কোনো অভিভাবক এ ভর্তুকির সুবিধা নিচ্ছেন।
প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, ২০টি দিবাযত্ন কেন্দ্রের প্রতিটিতে আসনসংখ্যা ৬০। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ভাড়া করা জায়গায় দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। চার মাস থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের সেখানে সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত রাখা হয়। মা–বাবার আয়ের ওপর ভিত্তি করে মাসিক খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে।
শিশুর বয়স অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোর মাসিক সেবামূল্য সর্বনিম্ন এক হাজার, সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা। তবে বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থাও রয়েছে। অভিভাবকের মাসিক আয় ৮ হাজার, ২০ হাজার, ৩৫ হাজার ও ৫০ হাজার টাকার নিচে হলে শিশুকে মাসে যথাক্রমে ১০০, ২০০, ৪০০ ও ৬০০ টাকায় রাখা যায়। কোনো কোনো অভিভাবক এ ভর্তুকির সুবিধা নিচ্ছেন।
‘২০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্পের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব শবনম মোস্তারী প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রগুলো স্থাপনে উন্নত দেশগুলোর দিবাযত্ন কেন্দ্র অনুসরণ করা হয়েছে। শিশুর প্রারম্ভিক শৈশবের চাহিদা পূরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় আসন নেই, ঢাকার বাইরে একরকম ফাঁকা
প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় ১০টি কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ে ৪০, ভূমি ভবনে ৪০, পানি ভবনে ১৫০, মহাখালীতে পর্যটন করপোরেশনে ৩৫, সড়ক ভবনে ৫৪, সমবায় ভবনে ২১ ও মতিঝিলে ১৩টি শিশুর জন্য আবেদন অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে। এ ছাড়া রায়েরবাজারের দিবাযত্ন কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রন্থাগার ভবন, ধানমন্ডির কেন্দ্র লালমাটিয়া ও মুগদার কেন্দ্র পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) স্থানান্তর করায় হওয়ায় সেগুলোতে অপেক্ষমাণ তালিকা নেই।
ঢাকার বাইরে টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা ও নোয়াখালীতে কোনো অপেক্ষমাণ তালিকা নেই। আর বাকি পাঁচটি কেন্দ্রের মধ্যে গাজীপুরে ২২, আশুলিয়ায় ৩, নওগাঁয় ৩, চাঁদপুরে ৫ ও কক্সবাজারে ৫টি শিশুর জন্য আবেদন অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক শবনম মোস্তারী বলেন, ঢাকায় আরও বেশি কেন্দ্র স্থাপন প্রয়োজন। আর ঢাকার বাইরের কেন্দ্রগুলো যেসব জায়গায় করা দরকার ছিল, সেসব জায়গায় প্রয়োজনীয় স্থান পাওয়া যায়নি। ফলে কেন্দ্রগুলো কর্মজীবী নারীদের জন্য দূরে হয়ে গেছে এবং সব আসন পূরণ হচ্ছে না। তাঁর মতে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর আঙিনায় অবকাঠামো করে কম খরচে উন্নত মানের দিবাযত্ন কেন্দ্র করা সম্ভব। এতে কর্মজীবী নারীরা উপকৃত হতেন।
‘মনে হতো চাকরি না, যেন পাপ করছি’
গত ১৮ ডিসেম্বর বেলা পৌনে তিনটার দিকে রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত পানি ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের নিচতলায় দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে কাঁঠালবাগান থেকে কেন্দ্রটি পানি ভবনে স্থানান্তর করা হয়।
প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুটের কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা যায়, কোনো মা তাঁর সন্তানদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কোনো মা অপেক্ষা করছেন সন্তানকে নেওয়ার জন্য। খোলামেলা পরিবেশের কেন্দ্রটিতে তখন মেঝেতে পাতা ফোমের বিছানায় বেশির ভাগ শিশু ঘুমাচ্ছে। শিশুরা নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরা। কয়েকটি শিশু খেলা করছিল। এক শিশু আপনমনে পুতুল নিয়ে দোলনায় দুলছিল।
কেন্দ্রের এক কর্নারে প্রতিটি শিশুর মা–বাবার সঙ্গে ছবি ফ্রেম করে দেয়ালে লাগানো। শিশুদের জিনিসপত্র রাখার জন্য আলাদা আলাদা স্থান। এক কোনায় স্লাইডিংসহ বিভিন্ন খেলনা, গল্পের বই, নাটকের পোশাক; আরেক কোনায় খাবার টেবিল, হাত ধোয়ার জায়গা। কাছাকাছি জায়গায় শৌচাগার ও রান্নাঘর।
চাকরিজীবী দম্পতি শান্তা ইয়াছমিন ও হাফিজুর রহমান তাঁদের ২১ মাস বয়সী সন্তান মেহরান রহমানকে নিতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল ছয় বছর বয়সী সন্তান সাইফান রহমান। শিশু হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট শান্তা ইয়াছমিন প্রথম আলোকে বলেন, সাইফান তিন বছর বয়স থেকে কাঁঠালবাগানের কেন্দ্রে ছিল। বয়স ছয় বছর হয়ে যাওয়ায় তাকে আর রাখা যায়নি। সে ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলের শিক্ষার্থী। স্কুলে শিশুশিক্ষার্থীদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে রেখেছেন।
সাইফানকে নিয়ে একবার এ-বাসায়, আরেকবার ও-বাসায় রাখার জন্য ছোটাছুটির কথা বলতে গিয়ে শান্তা কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘ওই দিনগুলোতে কান্না ছাড়া কোনো কথা বলতে পারিনি। মনে হতো, চাকরি না, যেন পাপ করছি। কর্মজীবী মায়েদের কষ্টের কথা ভেবে উন্নত মানের আরও দিবাযত্ন কেন্দ্র করা প্রয়োজন।’
আরেক শিক্ষক মা নীতু চক্রবর্তী জানান, তাঁর দেড় বছরের ছেলে অব্রীক চৌধুরীর জন্য আসন পেতে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ করেছেন। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতিতে একজন কর্মজীবী নারীর অনেক ভূমিকা রয়েছে। সেটি বিবেচনায় নিয়ে নারী যেন চাকরি না ছেড়ে সন্তান নিরাপদে রাখতে পারেন, সে লক্ষ্যে প্রতিটি অফিসে দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকা উচিত।
পানি ভবনের দিবাযত্ন কেন্দ্রটির প্রশংসা করে নীতু চক্রবর্তী বলেন, এখানে সন্তানকে রেখে স্বস্তিবোধ করেন। এখন শিশুদের কথা বলতে দেরি হওয়া ও ডিভাইস আসক্তির যে সমস্যা দেখা দেয়, তা দিবাযত্ন কেন্দ্রে রাখা শিশুদের ক্ষেত্রে হয় না। অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার কারণে শিশুদের মানসিক উন্নয়ন ও বিকাশ হয়। তবে একদম ছোট শিশুর জন্য খাবার মেনুতে পরিবর্তন আনা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পানি ভবন কেন্দ্রের দিবাযত্ন কর্মকর্তা আলেয়া সুলতানা বলেন, বয়স অনুযায়ী, শিশুদের খাবার তালিকা করা হয়েছে। রন্ধনকর্মী খাবার তৈরি করেন। তবে অনেকে বুকের দুধ ও বাড়তি খাবার রেখে যান। কেন্দ্রে ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁদের মধ্যে কেয়ারগিভার (শিশু পালনকারী), স্বাস্থ্য শিক্ষক, প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষক রয়েছেন।
৯ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি এ বছরের জুনে শেষ হবে। এরপর কেন্দ্রগুলো রাজস্ব খাতে চলে যাবে। তবে পুরোনো জনবলকে তাতে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।