খাদ্যশস্যে জিনগত পরিবর্তন কোম্পানির ব্যবসার জন্য, কৃষকের জন্য নয়
দেশীয় খাদ্যশস্য ও ফসলে জিনগত পরিবর্তন বা জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (জিএমও) প্রযুক্তি প্রয়োগ করে অবমুক্তির চেষ্টা বিদেশি বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসার জন্য করা হচ্ছে। এতে দেশের কৃষি, কৃষক ও মানুষের ভালো কিছু হবে না। জিএমও বিজ্ঞানের কোনো বিষয় নয়। খাদ্যশস্যে এ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক ও বিভক্তি রয়েছে।
বাংলাদেশি ধানের জাত ব্রি-২৯ ধানে ভুট্টার একটি জিন ঢুকিয়ে ‘গোল্ডেন রাইস’ নামে ধানের জাত তৈরি করে দেশের কৃষকদের কাছে এ জাত অবমুক্তির চেষ্টা নিয়ে আয়োজিত এক সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আজ সোমবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
‘জিএম শস্য গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুন: বাংলাদেশে প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের নিরসন জরুরি’ শীর্ষক এ সভা যৌথভাবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ), জিএমও বিরোধী মোর্চা, নয়াকৃষি আন্দোলন ও নাগরিক উদ্যোগ আয়োজন করে।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক নারীনেত্রী ফরিদা আখতার। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করছে, যা বেশ উদ্বেগজনক বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রবন্ধে ফরিদা আখতার বলেন, জিএমও গোল্ডেন রাইস চাষের অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) কর্তারা কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের সঙ্গে দেখা করে অবমুক্তিতে তাঁর সহযোগিতা চেয়েছেন। কৃষিমন্ত্রীও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু গোল্ডেন রাইসের প্রবক্তারা বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা দিতে পারেননি বলে ফিলিপাইনের আদালত এর বাণিজ্যিক চাষের বিরুদ্ধে নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রবন্ধে বলা হয়, গোল্ডেন রাইসে ধানের স্বাভাবিক গঠনে ভিন্ন ‘জিন’ জোর করে ঢোকানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের অধীন এ গবেষণা করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ব্রি-২৯ জাতের ধানে ভুট্টার জিন ঢুকিয়ে ভিটামিন এ সৃষ্টি করে বলা হয়েছে। এর মেধাস্বত্ব বহুজাতিক কীটনাশক বিক্রির কোম্পানি সিনজেনটার।
এতে বলা হয়, দেশের অধিকাংশ কৃষক ব্রি-২৯ ধান চাষ করেন। যেখানে কোনো মেধাস্বত্ব নেই। কৃষক নিজেই বীজ রাখেন কিংবা বাজার থেকে কেনেন। এ ধানের স্বত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে গেলে বাংলাদেশের কৃষকের ভাগ্যে কী ঘটবে? এ ছাড়া ভিটামিন এ দৈনন্দিন খাবারের বিভিন্ন শাক, আবাদি ফসল, হলুদ রঙের ফলে পাওয়া যায়।
প্রবন্ধে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ অনুমতি দেওয়া জিএমও শস্য বিটি বেগুন নিয়েও আলোচনা হয়। প্রবন্ধে বলা হয়, প্রচলিত সবজি বেগুনে জিনগত পরিবর্তন করে মাটির একটি ব্যাকটেরিয়া ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (বিটি) সংযোজন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, বেগুনের ফল ও কাণ্ডে ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধের ক্ষমতা। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) মাঠ পর্যায়ে বিটি বেগুন নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।
সভায় সূচনা বক্তব্য দেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘জিনগত পরিবর্তন করা খাদ্যশস্য নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে বিতর্ক চলছে। আমরাও খাদ্যশস্যে জিএমও প্রযুক্তির প্রবর্তনের বিরুদ্ধে। কারণ, জিএমও প্রযুক্তির কোনো শস্যে অন্য কিছু জিন ঢুকিয়ে দিলে এটার বিক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা সুনির্দিষ্ট করে বিজ্ঞান বলতে পারেনি। এমন বিপদযুক্ত জিনিসের প্রতি হ্যাঁ বলে ফেললে, বিপদ ঘটলে সামাল দেওয়া অসম্ভব হতে পারে।’
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, বিটি বেগুন নিয়ে ভারত বলেছে, জিএমও প্রযুক্তির শস্যের অনুমতি দিলে কোম্পানির বেশি লাভ হয়, দেশের কৃষকের খুব একটা লাভ হয় না। তাই অনুমতি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ একটা গিনিপিগ হয়ে গেছে। আগে বিটি বেগুনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, এখন গোল্ডেন রাইসের অনুমোদন দিতে চাইছে। ধানের মতো একটি শস্যে জিএমও অনুমতি দিলে পরিবেশ ও প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে সামলানোর ক্ষমতা সরকারের কি আছে?
জিনগত পরিবর্তনের বিষয়ে প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ জানিয়ে বীজবিস্তার ফাউন্ডেশনের সভাপতি এম এ সোবহান বলেন, বিটি বেগুন ও গোল্ডেন রাইস—দুটিই আত্মঘাতী। এখানে বিজ্ঞানের চেয়ে বাণিজ্যই বেশি। যে কোম্পানিগুলো এর পেছনে আছে, তাদের স্বার্থ হাসিল করতেই এসব করা হচ্ছে।
আলোচনা সভায় বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি বদরুল আলম, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন এবং জিএমও বিরোধী মোর্চার চেয়ারম্যান ইবনুল সাইদ প্রমুখ বক্তব্য দেন। খাদ্যশস্যে জিএমও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দেশে জিএমও শস্যের চাষাবাদের বিষয়ে স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান বক্তারা।