বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে অব্যাহতভাবে প্রতিবেশী দেশসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা রকম বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। একটি ‘বিশেষ মহলের’ এমন অপপ্রয়াসের জেরে সাম্প্রতিক সময়ে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে সোমবার দুপুরে ঢাকায় কূটনীতিকদের ব্রিফ করবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
রোববার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নিয়ে বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের জেরে সৃস্ট অস্থিরতার বিষয়টি তুলে ধরা হবে। সেই সঙ্গে গ্রেপ্তার পুরোহিত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ, ইসকনসহ সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের বিষয়েও সরকারের অবস্থান বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরা হবে।
সোমবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠেয় ওই ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিক মিশনগুলোর প্রতিনিধিদের পাশাপাশি জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব রয়েছে। এক সপ্তাহের বেশি সময়জুড়ে ইসকন ইস্যুটি সামনে এসেছে। জেনেভায় জাতিসংঘের সংখ্যালঘুবিষয়ক ফোরামে গত সপ্তাহের এক আলোচনায় সংখ্যালঘু নির্যাতানের প্রসঙ্গটি এসেছে। এদিকে গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের একটি বহুদলীয় গ্রুপ অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ (এপিপিজি) ফর দ্য কমনওয়েলথ বাংলাদেশ নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছে। ওই প্রতিবেদনেও সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গ এসেছে। ফলে বিষয়টি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একধরনের চাপ বা অস্বস্তি তৈরি করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নানা রকম সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এসব সংবাদের অনেকটাই অসত্য বলে দাবি করে আসছেন। সোমবার অনুষ্ঠেয় ব্রিফিংয়ে সরকারের এই বক্তব্যের পক্ষে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো জানানো হবে। এর পাশাপাশি চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময় অনুসারীদের হামলা শুরু করা এবং আদালত এলাকায় আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যা। এ ঘটনায় দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হলেও কোনো পাল্টা আক্রমণের ঘটনা না ঘটার বিষয়টিও তুলে ধরা হবে। সেই সঙ্গে সব ধর্ম বিশ্বাসের লোকজনের নিরাপত্তায় সরকার যেসব ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরা হবে।
জানা গেছে, সামগ্রিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য তুলে ধরা হবে তা হলো, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে হামলা করা হচ্ছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম পরিকল্পিতভাবে যে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। বরং যেসব ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় সবগুলোই কাকতালীয়ভাবে ব্যক্তিস্বার্থ, পুরোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জের। ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে রং লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে পতিত সরকারের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। পাশাপাশি ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
এ ছাড়া ৫ আগস্টের আগের ও পরের বাংলাদেশ এক নয়, সেটি স্পষ্ট করবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। এই বাস্তবতা মেনে অর্থাৎ বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব, স্বার্থ ও মর্যাদা বজায় রেখেই যে দুনিয়ার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী, তা তিনি ব্যাখ্যাসহ তুলে ধরবেন। উপদেষ্টার বক্তব্যে এটা স্পষ্ট করা হবে যে ধর্মীয় পরিচয়-নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার বদ্ধপরিকর। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পরাজিতরা তাদের দেশি-বিদেশি বন্ধুদের নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা যড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা সংখ্যালঘু নির্যাতন বা অন্য ইস্যু তৈরি করতে মরিয়া। তাদের একমাত্র লক্ষ্য, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃস্টি এবং বিদেশে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা।