ক্ষোভ থেকে বাঁচেনি জাতীয় শিশু একাডেমি, পুড়েছে মূল্যবান সম্পদ
রাজধানীর দোয়েল চত্বরের কাছে অবস্থিত জাতীয় শিশু একাডেমি এখন ধ্বংসস্তূপ। ভবনের কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, তবে ভেতরের প্রায় সবই ছাই। প্রশাসনিক ভবন থেকে মুদ্রণ শাখা, জাদুঘর থেকে প্রশিক্ষণকক্ষ—সবকিছু তছনছ করেছে দুর্বৃত্তরা। এখানকার বিক্রয় ও বিপণনের ‘দাদাভাই’ হল ভবনটি বাদে সব কটি ভবনে হামলা হয়েছে।
৫ আগস্ট দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর গণভবনমুখী মানুষের জোয়ার শুরু হয় ঢাকা শহরজুড়ে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন প্রথম আলোকে জানালেন, ‘সেদিন সাধারণ ছুটি থাকায় জাতীয় শিশু একাডেমির কার্যক্রম বন্ধ ছিল। উপস্থিত ছিলেন শুধু গার্ডরা। তাঁরা সংখ্যায় কিছুই না জনস্রোতের কাছে। যতটুকু জেনেছি, গুলিস্তান থেকে গণভবনমুখী জনতার স্রোতের একটি অংশ ঢুকে পড়ে জাতীয় শিশু একাডেমির ভেতর। পুরো শিশু একাডেমি ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।’
আজ বিকেলে শিশু একাডেমিতে প্রবেশ করে দেখা যায়, কর্মকর্তাদের অনেকেই বসে আছেন বাইরে। তাঁদের কারও নিজের দপ্তরে বসার অবস্থা নেই। সবই পুড়ে ছাই। নিরাপত্তার জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছে বৈদ্যুতিক লাইন। প্রতিষ্ঠানের গাড়িগুলোর পোড়া কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। প্রশাসনিক ভবনের দোতলায় ছিল পাঠাগার। সব জানালা ভাঙা। পাঠাগার থেকে সব কম্পিউটার নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানালেন কর্মকর্তারা। নিচতলায় মহাপরিচালকের কার্যালয়ের একটি কক্ষ ছাড়া সবটাই পুড়ে ছাই।
প্রশাসনিক ভবনের পাশে জাদুঘর ভবনের তিনটি তলার সবই ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখানকার দ্বিতীয় তলায় আছে ৭২টি শোকেস। যেখানে বাংলাদেশের প্রাচীনকাল থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, এর প্রতিটি ভাঙা। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সব শিল্পকর্ম। রেহাই পায়নি নিচতলার শেখ রাসেল আর্ট গ্যালারি। তিনতলায় ২৭টি শোকেসে রাখা ২৭ দেশের স্মারকের অবস্থাও একই। উল্টো দিকের মিলনায়তন ভবনের নিচতলায় ছিল শিশু পত্রিকা প্রকাশনা এবং প্রকাশনা বিভাগ। সেটা এখন শুধু ছাইয়ের ধ্বংসস্তূপ। কিছুই অবশিষ্ট নেই। পুড়ে যাওয়া আলমারির ভেতর থেকে বের হয়ে আছে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া অংশ।
প্রকাশনা বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসার মো. কামরুজ্জামান বললেন, ‘শিশু একাডেমির প্রতিষ্ঠাকালের পত্রিকা থেকে শুরু করে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ছিল এখানে। দেড় হাজারের বেশি সিডি ক্যাসেট ছিল বইয়ের ব্যাকআপ কপি হিসেবে। অনেক গুণী লেখকের স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপি ছিল। এসবের কিছুই আর এখন নেই।’
এই ভবনের দোতলায় প্রশিক্ষণ হলে ছিল বাদ্যযন্ত্র। সদ্য কেনা সেতার, বেহালা থেকে হারমোনিয়াম—কিছুই আর এখন অবশিষ্ট নেই। সবই লুট হয়ে গেছে বলে জানালেন কর্মকর্তারা। ছাইয়ের স্তূপের ভেতর দেখা গেল, পড়ে আছে শিশুদের নাটকের পোশাক। বাইরে তখন দগ্ধ ‘দুরন্ত’ গড়াচ্ছে মাটিতে। কাঠি দিয়ে চাকা নিয়ে খেলতে খেলতে দৌড়ে যাওয়া সেই চিরচেনা দুরন্তের সারা শরীর অঙ্গার হয়েছে। অক্ষত আছে শুধু মুখটুকু। ডান পাশেই ছিল শেখ রাসেলের ম্যুরাল। সেখানে পেছনের দেয়ালটুকু ছাড়া আর কিছু ছিল বলে বোঝার আর কোনো অস্তিত্ব নেই এখন।