ল্যাব চালু হয়নি ৫ বছরে, হালাল সনদ দিচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন
বিদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে হালাল সনদের গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ সনদ দিচ্ছে। পণ্য হালাল কি না, তা পরীক্ষায় বিএসটিআইয়ের ল্যাব সচল রয়েছে। তবে পাঁচ বছর আগে উদ্বোধন হলেও এ ল্যাব চালু করতে পারেনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন যাচাই করে তাঁরা এ সনদ দিয়ে থাকেন। তাঁদের ল্যাবটি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা। ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আইন প্রণীত হয়। এ আইনে কোথাও হালাল পণ্যের সনদ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ নেই। ২০০৭ সালের আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ সনদ দিয়ে আসছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সিটিজেন চার্টারেও খাদ্যপণ্য ও ওষুধসামগ্রীর হালাল সনদ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। হালাল পণ্যের সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনপত্রের সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট নিবন্ধন সনদ, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) সনদ, বিএসটিআইয়ের সনদ, ঔষধ প্রশাসনের সনদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, পণ্যের উপকরণ বিবরণী, পণ্য উৎপাদনের ফ্লো চার্ট ইত্যাদি খতিয়ে দেখে ফাউন্ডেশন।
হালাল সনদ দিতে প্রতিষ্ঠানটি একটি ল্যাব তৈরি করে। ২০১৭ সালের ৪ আগস্ট ল্যাবটি উদ্বোধন হলেও সেটি কখনোই সচল হয়নি। সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল ডায়াগনস্টিক ল্যাবে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি যন্ত্রপাতি ও বোতল ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। একটি রেজিস্টার খাতায় ২০২০ সালে বোতলজাত পানি এবং মিনিকেট ও পোলাও চালের গুঁড়া পরীক্ষা করার কথা উল্লেখ আছে। কার্যক্রম বলতে এটুকুই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ল্যাবটিতে পণ্য পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পিসিআর মেশিন নেই। তাদের নিজস্ব কেমিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট নেই। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্যের যে সনদ দেয়, তার ওপর নির্ভর করেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গঠিত কমিটি হালাল সনদ দেওয়ার সুপারিশ করে। সনদ দেওয়ার আগে অবশ্য কমিটি ওই পণ্যের কারখানা পরিদর্শন করে বলে জানানো হয়েছে। হালাল ল্যাব ও সনদ প্রদান কার্যক্রম শক্তিশালী করতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। তবে প্রকল্পটি কয়েক বছর ধরে আলোচনার টেবিলে রয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ল্যাবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জনবল নিয়ে অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন প্রতিষ্ঠানটির হালাল সনদ বিভাগের মুফাসসির ও উপপরিচালক মো. আবু সালেহ পাটোয়ারী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সনদ দেওয়ার জন্য নিজস্ব ল্যাব ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা জরুরি। থাকতে হবে ইসলামি বিশেষজ্ঞ। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগের যন্ত্রপাতি-জনবল রয়েছে। অপর দিকে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ল্যাব থাকলেও তা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। নেই ইসলামি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের প্রতিনিধি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসটিআইয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত এপ্রিলেই একটি প্রতিষ্ঠানের নয়টি পণ্যের হালাল সনদ দিয়েছে বিএসটিআই। স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাব, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জনবল—সবই আছে সংস্থাটির। নিয়ম মেনে সব ধরনের পরীক্ষা করে তারপরই সনদ দেওয়া হচ্ছে। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর হালাল সনদবিষয়ক সংস্থা স্মিকের সদস্য হিসেবে ও দেশি পণ্যের রপ্তানি সম্প্রসারণের জন্য বিএসটিআই সনদ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
আবু সালেহ পাটোয়ারী বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে হালাল সনদ নিয়ে ৬০টির মতো কোম্পানি ৩৩টির বেশি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। খাদ্যপণ্য, মাছ-মাংস, প্রসাধনসামগ্রী, কাপড়, গরু ও মহিষের হাড় ও হাড়ের গুঁড়া থেকে তৈরি জিলেটিন, লুঙ্গি, থ্রি–পিসসহ নানা পণ্যের জন্য সনদ নিয়েছে কোম্পানিগুলো।
২০০৭ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত হালাল সনদ দেওয়ার মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৫ কোটি ২৭ লাখ ৪০ হাজার টাকার বেশি আয় হয়েছে। চলতি বছর সনদ দেওয়া বাবদ ফাউন্ডেশনের আয় এক কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলেও জানান হালাল সনদ বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মো. মুশফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অন্য যেসব প্রতিষ্ঠানের সরকার অনুমোদিত ল্যাব আছে, তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনগুলো সন্তোষজনক হলেই হালাল সনদ দেওয়া হচ্ছে। দেশে যখন হালাল সনদ দেওয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন জরুরি প্রয়োজনেই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ফাউন্ডেশন সনদ দেওয়া শুরু করেছিল, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
ল্যাব চালু না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ল্যাবটি চালুর পরিকল্পনা আছে। হালাল সনদ দিতে এ ল্যাবে যাতে একাধিক পরীক্ষা করা যায়, তারও চিন্তাভাবনা চলছে। তবে এ সনদ দিতে এত কিছু দেখতে হয় যে একটি ল্যাবের পক্ষে তা সম্ভব নয়, বিভিন্ন ল্যাবে যেতেই হবে।
যেভাবে সনদ দিচ্ছে বিএসটিআই
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই। পণ্যের মান, ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিতে জাতীয় মান নিয়ন্ত্রক তারা। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় একটি গেজেট জারি করে। সেখানে বলা হয়, বিএসটিআই হালাল সনদ দেবে।
গেজেটে বলা হয়েছে, ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য, প্রসাধনসামগ্রী, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া বা সেবাকে ‘হালাল’ বলে। বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্রশিল্পের হালাল সনদ বা নবায়ন ফি এক হাজার টাকা, মাঝারি শিল্পের তিন হাজার টাকা এবং বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা।
কোনো প্রক্রিয়াজাত দ্রব্যের গায়ে বা লেবেলে অথবা প্রক্রিয়া বা সেবার অনুকূলে হালাল মার্ক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সনদের জন্য বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত ফরমে সংস্থাটির মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে হয়। সনদ দেওয়া হয় তিন বছরের জন্য। মেয়াদ শেষে নবায়নের আবেদন করা যায়।
গেজেটে বলা হয়, সনদ দেওয়ার আগে বিএসটিআইয়ের হালাল নিরীক্ষা দল সবকিছু যাচাই করবে। এরপর হালাল সনদ কমিটি বিএসটিআইয়ের কাছে সুপারিশ করবে। বিএসটিআই সন্তুষ্ট হলে সনদ দেবে। কোনো শর্ত লঙ্ঘিত হলে বিএসটিআই পরে হালাল সনদ স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে।
সনদের জন্য আবেদন করার সময় প্রতিষ্ঠান ও কারখানার নাম-ঠিকানা, ব্র্যান্ড, পণ্যের নাম ইত্যাদি উল্লেখ করতে হবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে আবেদনকারীর নিজের এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মালিক, অংশীদার বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর থাকতে হবে।
হালাল পণ্যের সনদ দেওয়ার বিষয়ে বিএসটিআই এরই মধ্যে অর্গানোগ্রাম পরিবর্তন করেছে। হালাল সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, এফবিসিসিআই, বিসিআই, ডিসিসিআই, ক্যাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ফার্মাসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ও মাদ্রাসা-ই-আলিয়া এবং কওমি মাদ্রাসার বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিরা রয়েছেন।
বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক কে এম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, বিএসটিআই এখন পর্যন্ত ২০টি পণ্যের হালাল সনদ দিয়েছে। বিএসটিআই আলাদা করে আবেদন ফি নিচ্ছে না। একটি প্রতিষ্ঠান থেকেই হালালসহ সব সনদ পাচ্ছে বলে মানুষের ভোগান্তি কমেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাদের মতো করে সনদ দিচ্ছে। বিএসটিআইয়ের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। মানুষ যেখান থেকে গুণগত মানসম্পন্ন সেবা পাবেন, সেই প্রতিষ্ঠানের কাছেই যাবেন।