‘বিভাজনের রাজনীতি করতে গেলে মাশুল দিতে হবে’

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ‘দুঃসময়ের কণ্ঠস্বর: তাঁদের স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। ঢাকা, ২১ সেপ্টেম্বরছবি: দীপু মালাকার

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ গড়ার একটি সুযোগ এসেছে। এখন বিভক্তির রাজনীতি করা যাবে না, জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। বিভাজনের রাজনীতি করতে গেলে মাশুল দিতে হবে।

‘দুঃসময়ের কণ্ঠস্বর: তাঁদের স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন আলোচকেরা। আজ শনিবার রাজধানীর বিআইআইএসএস মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এ সভার আয়োজন করে।

সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সমাজের প্রতিটি জায়গায় ফ্যাসিজমের দোসররা গ্রোথিত। ফলে এক রাতে সবকিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, অনেক দিন অপশাসন ও ফ্যাসিজমের মধ্যে থেকে কিছু বিষয় সমাজের নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একটি আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য যাত্রা শুরু করতে হবে।

সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনার আহ্বান জানিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এখন যেহেতু কথা বলতে পারছি, যত সমালোচনা করা দরকার, তা হোক। কিন্তু তা যেন গঠনমূলক ও ফোকাসড (বিষয় নির্দিষ্ট) হয়।’

নতুন করে যে স্বাধীনতা এসেছে, সেটাকে নিজের মনে করার আহ্বান জানান সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এই সফলতার ফসল যেন ঘরে আসে, সে ভূমিকা সবাইকে রাখতে হবে। নয়তো স্বপ্ন, প্রত্যাশা অপূর্ণ থেকে যাবে। মাশুল সবাইকে দিতে হবে। তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে যদি বিভক্তির রাজনীতি হয়, তাহলে সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ পাবে না।

ভালো মানুষকে রাজনীতিতে আনা ও সে সুযোগ তৈরির তাগিদ দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, বিগত ৩০ বছরে ভালো মানুষ রাজনীতিতে আসতে চায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানো আর সরকার চালানো এক জিনিস নয়। এই সরকারের প্রথম ভুল হলো, গণ-অভ্যুত্থানকে শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কৃতিত্ব হিসেবে নেওয়া, যা ঠিক নয়। এটা বিগত ১৫ থেকে ১৭ বছর ধরে তৈরি মানুষের ক্ষোভ থেকে হয়েছে। এই আন্দোলনে সবাই এক হতে পেরেছে।

ফ্যাসিস্টরা এখনো সক্রিয় আছে উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঠেকাতে হবে। এখন গণতান্ত্রিক ঐক্য দরকার। রাজনৈতিক ও জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। সরকারকে আরেকটু সক্রিয় হতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক মামুন আবদুল্লাহি বলেন, বিগত ১৫ বছর দেশে বিভাজনের রাজনীতি দেখা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর যে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠার কথা ছিল, সেটা হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যা যা ছিল, বিশেষ করে মানুষের মর্যাদা, তা জাতির মধ্যে গড়ে ওঠেনি। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে দেখা গেল। তিনি বলেন, তবে এবার একটা দিক শক্তভাবে গড়ে উঠতে দেখা গেল, সেটি হলো, এমন আর হতে দেওয়া যাবে না। এ কারণে এক দিনের মধ্যেই অনেক পদক্ষেপ দেখা গেল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে মেয়েদের অবস্থানের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পুরো আন্দোলনে মেয়েদের যে ভূমিকা ছিল, সেটা আর দেখা যাচ্ছে না। তাঁদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। তিনি বলেন, এবারের আন্দোলন থেকে অনেক নারী নেতৃত্ব উঠে আসবে, এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দু-তিনজন বাদে বেশির ভাগই অবদমিত হয়েছে। আন্দোলনে সবাই অংশ নিলেও ক্ষমতা কিছু মানুষ ও গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের লম্বা ইতিহাস আছে বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। বিগত সরকারের সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তখন কথা বলার ক্ষেত্রে ভয় ছিল, এটা ঠিক। তবে কথা না বলার জন্য ভয়কে অতিরঞ্জিতও করা হতো।

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকাঠামোর যদি মৌলিক পরিবর্তন না হয়, তাহলে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না। একটা সুযোগ এসেছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এই সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপ দিতে হবে।

পাহাড়ের পরিস্থিতি তুলে ধরেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা। তিনি বলেন, সব সরকারই পার্বত্য চট্টগ্রামকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়। সেখানে পৃথক শাসনব্যবস্থা চলে।

সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে বার্তা সংস্থা এএফপি বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেক (তথ্য যাচাই) সম্পাদক কদরউদ্দিন শিশির বলেন, সাংবাদিকেরা যদি ইচ্ছা করেন যে কোনো সরকারের কাছে বিক্রি হবেন না, তাহলে নিরপেক্ষ থাকা। গত কয়েক বছরে ব্যতিক্রম কিছু গণমাধ্যম বাদে বেশির ভাগ অপতথ্য ও অপপ্রচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। স্বাধীন গণমাধ্যম ব্যবস্থা গড়ে ওঠা জরুরি।

শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, কারখানায় কোনো কিছু হলে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হয় না, মালিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়। শ্রমিক অসন্তোষ দূর করতে হলে শ্রমিকদের সঙ্গে বসতে হবে।

আলোচনা সভাটিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মামলা, হামলা, হয়রানিসহ বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার ব্যক্তিরা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা বলেন, তাঁর সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, সেটা বলার সাহসও ছিল না। এখন তিনি সাহস পাচ্ছেন।

সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান, এশিয়া ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, ডিএসএ ভিকটিমস নেটওয়ার্কের সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, সাংবাদিক মাসুদ কামাল ও মুক্তাদির রশীদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য প্রীতম দাস, অনলাইন সাময়িকী জবানের সম্পাদক রেজাউল করিম, সাবেক সেনা কর্মকর্তা রেজাউল করিম এবং আইপিনিউজ বিডির বিশেষ প্রতিবেদক উ মিমি মারমা মিমি।