এই সব দিনরাত্রি

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

গত দুই দিনে রিলস দেখাটা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। নির্ঘুম চোখ দুটি খোঁজে ছাত্ররা ভালো আছে তো! মাঠে না থাকলেও ঘরে বসে বসেও আমি তাদের সহযোদ্ধা। রক্ত, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ এসব বড্ড ভয় লাগে আমার। রক্ত দেখলেই আমি অন্য মানুষ হয়ে যাই, তাই মেডিকেলে ক্লাস করতে গিয়েও ছয় মাস পর বুয়েটে চলে আসি।

করোনা দেখেছি, তাই গৃহবন্দী ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। তখন অবশ্য ফেসবুক চালাতাম না। ভর্তি পরীক্ষার পড়ায় ব্যস্ত থাকতাম, কোরআন তিলাওয়াত করতাম। আর সবাই মিলে লুডু—মন্দ কাটেনি।

এর আগেরও এক কারফিউর কথা মনে আছে। ২০০৭ সালে খবর না দেখে কোচিংয়ে এসে কনকর্ড আর্কেডিয়ার সপ্তম তলার জানালা থেকে দেখি, বিসিএসআইআরের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মহড়া। ভয় পেয়েছিলাম—ফেরার পথে না জানি কী হয়! নিরীহ মা, যাঁর কোলে এক পিচ্চি আর হাতের পিচ্চিটা আমি।

আজ ১৭ বছর পরের সেই কারফিউর সঙ্গে নতুন সংযোজন—ইন্টারনেট সরবরাহে বিঘ্নতা। আজ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত ইন্টারনেট, অনেকের জন্য ‘অক্সিজেন সমতুল্য’। এই আমি বই পড়ি না, ছবি আঁকি না, টার্ম ফাইনাল শেষের দীর্ঘ অবকাশ পেরিয়ে ক্লাসে ফেরার প্রহর গুনছি, ফেসবুক থেকে ইনস্টাগ্রামের রিলসে চোখ বোলাতে বোলাতে আবার বিরক্ত হয়ে কখনো ইউটিউব শর্টের দ্বারস্থ হচ্ছি। এমন সময় ইন্টারনেটবিহীন কারফিউ আমায় ছন্নছাড়া করে দিল; সঙ্গে বদলেও দিল। ভার্সিটির এই সময়ের আমরা ফোন দিয়ে বলি, ‘মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ চেক কর, ৩০ সেকেন্ডের কথোপকথন, বড্ড হিসাবি আমরা। সেই হিসাবি বন্ধুরা রিচার্জও করতে পারছি না। এমন সময়েও ইমার্জেন্সি ব্যালান্স নিয়ে একে অপরকে ২ টাকা ৪৪ পয়সা প্রতি মেসেজে বন্ধুদের খোঁজ নিয়ে চলেছি।

আমার এক বন্ধুর মেসেজটা এখানে উল্লেখ করি:

প্রিয় তমু,

ঘর অন্ধকার। জ্যোৎস্নামাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে, আজ থেকে ২০ বছর আগের পৃথিবীতে চলে এসেছি। যখন ছিল না ইন্টারনেটের রমরমা, ছিল না এত ইনফরমেশনের ছড়াছড়ি। সত্যি বলতে একরকম প্রশান্তি অনুভব করছি। নেই কোনো স্ক্রলিংয়ের প্রতিযোগিতা, নেই ‘সবকিছু জানতে হবে’ এমন মনোভাব।

১৫ বছর আগে চাহিদা কম ছিল; টিভিতে কার্টুন, প্লেটে খাবার দিলেই দিল খুশ। বন্ধুদের সঙ্গে এলাকায় ক্রিকেট-ফুটবল খেলা আর মাঝেমধ্যে আত্মীয়দের বাসায় যাওয়া অথবা তাঁদের আমাদের বাসায় আসা, এই ছিল আমার দুনিয়া। দেশের এই পরিস্থিতিতে অবশ্য কারও বাসায় আসা-যাওয়ার সুযোগ নেই। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলাও এখন আর নেই। শুধু মুভি-সিরিজ দেখে সময় যেন আর কাটে না। তাই বেশি দিন এমন চলতে থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসবে নিশ্চিত।

মন কিছুটা বিক্ষিপ্ত হলেও আল্লাহর রহমতে আমরা সুস্থ আছি। সুযোগ পেলে তোমার ওদিককার খবর জানিও। ভালো থেকো।

—ফাহমিদ

তাঁর এই খুদে বার্তা তো আর খুদে বার্তা নয়, যেন চিঠি। অবসরের এই সময়ে এবং দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে তাঁর লেখকসত্তা প্রস্ফুটিত হয়েছে!

এমন সময়ে আমি তারই উপহার দেওয়া হুমায়ূন আহমেদের উঠোন পেরিয়ে দুই পা বইটি পড়ার চেষ্টায় আছি। বই হাতে নিয়ে মনোযোগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারছি না, কিছুক্ষণ পরপর দুই দণ্ড উঠে হেঁটে এসে আবার সেই বই–ই সঙ্গী। হুমায়ূন আহমেদের এই বই পড়ে দেশের প্রতি মমত্ববোধ আরও বেড়ে যায়, সময়–সময় মনে হয়, এই দেশের পথঘাট-প্রান্তর, আলো-বাতাস ছাড়া পৃথিবীর বাকি সব ঐশ্বর্য মূল্যহীন।

যখন এটি লিখছি, ২০ জুলাই পেরিয়ে ২১ জুলাইয়ে কেবল সময় গড়াল।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, দেশে যেন আবার স্থিতি ও শান্তি ফিরে আসে, আমরা যেন ফিরে যেতে পারি ক্লাসে, যে যাঁর কর্মস্থলে। যদিও এই জেনারেশন রিলস দেখা নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত, তারপরও শান্তিতে রিলস দেখাকে আমি মিস করি!

তবে মা–বাবাদের কোনো সমস্যাই নেই। তাঁরা আজও এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত নন। সময় দিব্যি কেটে যাচ্ছে তাঁদের। তবে হ্যাঁ, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেই চলেছেন তাঁরা অবশ্য, কিন্তু আমাদের মতো আসক্ত প্রাণীর মতো ছটফট তো করছেন না; বরং আমাদের এই অবস্থা দেখে রীতিমতো স্বস্তি পাচ্ছেন; আবার মুচকি হাসিতে ঝলমলও করে উঠছে তাঁদের মুখ।