পান্না কায়সারের স্মৃতিকথা: শক্ত করে ওর হাত টেনে ধরেও পারলাম না, ছুটে গেল
লেখক, গবেষক, শিশু সংগঠক ও সাবেক সংসদ সদস্য পান্না কায়সার আজ শুক্রবার সকালে মারা গেছেন। ২০০৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে তাঁর এই লেখা ছাপা হয়। পাঠকের জন্য তাঁর সেই লেখাটি আজ প্রথম আলো অনলাইনে পুনরায় প্রকাশ করা হলো।
মানুষের জীবনে কখন কী ঘটে যায়, কেউ বলতে পারে না। ভাগ্যনিয়ন্তা একমাত্র ওপরওয়ালা। বিয়ের আগে কি ভেবেছিলাম, এই ডিসেম্বর মাস চিরকালের জন্য আমার অন্তরে রক্ত ঝরাবে! শুধু ডিসেম্বর কেন, সারা বছরই আমার ভেতরে রক্তক্ষরণ চলে। আপনজনদের বুঝতে দিই না, বা আপনজনেরা বুঝতেই চেষ্টা করে না। এ নিয়ে আমার কোনো দুঃখও নেই। বলছিলাম ডিসেম্বরের আমার ভারাক্রান্ত দুঃসহ দিনগুলোর কথা। ডিসেম্বর এলেই আমি আর আমার মধ্যে থাকতে পারি না। দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতি বারবার আমাকে যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে। ডিসেম্বরের ৩ থেকে ১৪ এবং ১৬ তারিখ। স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলো আমার ভেতরটা তোলপাড় করে। বাইরে স্বাভাবিক, অথচ ভেতরে অন্য রকম। দুঃসহ স্মৃতির যন্ত্রণায় ভেতরটা কুঁকড়ে কুঁকড়ে যায়। আমার খুব কষ্ট হয়; এমন দুঃসহ স্মৃতিগাথার কথা কারও সঙ্গে ভাগ করতে পারি না। হয়তো তারা বুঝতে চেষ্টা করে না, বা করলেও আমি আরও কষ্ট পাব, সে জন্য হয়তো আড়াল করে রাখে। এ মাসটায় আমার সবকিছু থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছা করে। একটু একটু করে স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে নিজের মধ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখি। ছেলেমেয়েরা কতটুকু বুঝতে পারে, তা আমি জানি না। ওদেরও হয়তো ভেতরটা তোলপাড় করে। আমি কষ্ট পাব, সে জন্য ওরাও নিজেকে আড়াল করে রাখে।
ডিসেম্বরের ৩ তারিখে হঠাৎ যুদ্ধ। ঢাকা শহর কেঁপে কেঁপে উঠছে মেশিনগান আর মর্টারের শব্দে। কখনো কখনো মনে হতো, গোটা বাড়িটাই (২৯ বি কে গাঙ্গুলী লেন) কেঁপে উঠছে। আমার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে (শমী-অমি) নিচে বিছানা পেতে থাকা শুরু করলাম। মর্টারের ভীষণ শব্দে শমীর জ্বরই এসে গেল। অমি তো মাত্র কয় মাসের। বুকের উষ্ণতা দিয়ে ওদের প্রচণ্ড শব্দ থেকে বাঁচিয়েও যেন মনে হতো, এই বুঝি মর্টার বা মেশিনগানে বাড়িটা উড়ে যাবে। শহীদুল্লা ৪ তারিখ বিকেলবেলা বড় বড় অক্ষরে লেখা কয়েকটি লাইন আমার সামনে ধরল—‘জয়তু বাংলাদেশ’, ‘জাগো বাঙালি জাগো—আমরা এখন স্বাধীন’। বলল, ‘দেশ তো স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, এখন সময়ের ব্যাপার। দেশ স্বাধীন হলেই তো সংবাদ বের হবে।’ আমাকে প্রশ্ন করল, ‘কী হতে পারে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবাদ পত্রিকার হেডলাইন।’ এ ব্যস্ততাই ওকে ঘিরে রেখেছে সারাক্ষণ। একদিন এসে দুটি কবিতার লাইন দেখাল—
‘দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর
তুমি এলে সাজ সাজ রবে স্বাধীন হয়ে।’
লাইন দুটি চিরকালের জন্য আমার বুকে গাথা হয়ে গেছে। আমি প্রশ্ন করলাম, আর কয় দিন? কারফিউ, ব্ল্যাকআউট আর ভালো লাগে না। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘শত্রুপক্ষ পিছু হটছে, আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লাল সবুজ পতাকা!’
এরই মধ্যে এয়ারপোর্ট রোড (পুরোনো), মহাখালী-তেজগাঁও এলাকার বেশ কিছু আত্মীয় আমাদের বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। কারণ, এয়ারপোর্ট কাছে—কখন কার বাড়িতে শেল নিক্ষিপ্ত হয়! গোটা বাড়িতে মানুষ। শুধু ডাল-চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হতো। কারফিউ, ব্ল্যাকআউটের মধ্যে বাজার কোথায়!
১২ ডিসেম্বর সকালবেলা নূরুল ইসলাম ভাই এলেন। বর্তমানে গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি। যুদ্ধ চললেও মাসে মাসে দু-এক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হতো। সেদিন কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ উঠলে নূরুল ইসলাম ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে বলতে এসেছিলেন, ‘আপনি বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকেন।’ আর কী কী আলাপ হয়েছে, শুনতে পাইনি। নূরুল ইসলাম ভাই চলে গেলে এ বিষয়টি নিয়ে আমার শাশুড়ি, আমি খুব করে বললাম। রুশ দূতাবাসে ওর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রথমটায় শহীদুল্লা রাজি হতে চায়নি; কারণ, ও বলতে চেয়েছে, ‘এতগুলো মানুষ এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আর তাদের ফেলে আমি কাপুরুষের মতো চলে যাব?’ কিন্তু আমার শাশুড়ি জোর করার কারণে ঠিক হলো, পরদিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর কারফিউ উঠলেই সরে পড়বে।
যথারীতি ১৩ ডিসেম্বর শহীদুল্লা বাসা থেকে বের হয়ে গেল একটি ছোট ব্যাগ নিয়ে। আমার ও শাশুড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘স্বাধীনতার তিলক পরে ঘরে ফিরব।’ কিন্তু কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই সে ফিরে এল। বলল, ‘কালকে পান্নাকে আর বাচ্চাদের নিয়েই যাব।’ বাড়িতে আমরা এ নিয়ে খুব রাগারাগি করলাম। বাধ্য হয়ে আমিও প্রস্ত্ততি নিলাম, পরদিন ওর সঙ্গে আমিও যাব। ১৪ তারিখ সারা দিনে কারফিউ ওঠেনি। আমাদের আর যাওয়া হলো না। এ ১৪ তারিখই যে আমার সঙ্গে ওর মিলনখেলা শেষ, কে জানত! ১৪ ডিসেম্বর এ দেশের কুখ্যাত আলবদর-আলশামসের সদস্যদের কয়েকজন মুখে কালো কাপড় বেঁধে ২৯ বি কে গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে ঢুকে ওকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল। আমি শক্ত করে ওর হাতখানা টেনে ধরেও পারলাম না; ওদের টানাহেঁচড়ায় আমার হাতখানা ছুটে গেল। রাতের নিকষ অন্ধকারে আমার প্রিয় মানুষটি হারিয়ে গেল।
১৪-১৫ ডিসেম্বর আমি প্রায় অজ্ঞানই ছিলাম। ১৬ তারিখ সকালে আমার দেবর জাকারিয়া এসে বলল, ‘ভাবি, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।’ হু হু করে কেঁদে উঠল সে। আমার পায়ের কাছে বসে বলল, ‘বড়দাকে (শহীদুল্লা কায়সার) খুঁজতে যাবে না? চলো।’ আমি তখনো বিশ্বাস করে বসে আছি, শহীদুল্লা হয়তো বা কোনো কারাগারে আটকে পড়ে আছে। আমি ও ছোড়দা (জাকারিয়া) রিকশায় উঠলাম। রিকশা এসে থামল রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। নৃশংস, বীভৎস দৃশ্য দেখে আমি যা বোঝার বুঝে ফেলেছি। নিজেকে তৈরি করে ভেতরে শক্তি অর্জন করে হাজার হাজার গলিত লাশ আমি উল্টেপাল্টে দেখলাম। আমার মতো এ রকম আরও অসংখ্য। একটি লাশ খুঁজে পাওয়ার কী আপ্রাণ চেষ্টা! পেলাম না। আমি পেলাম না আমার আপনজনের লাশখানাও।
একাত্তরে যারা স্বাধীনতা চায়নি, পাক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তান রক্ষা করার নামে লাখো বাঙালি নিধন করেছে; সেই যুদ্ধাপরাধীরা আজ সমাজে, রাজনীতিতে বিশেষ অবস্থানে বুক ফুলিয়ে অবস্থান করছে। সেই সব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর আজও বিচার হয়নি। অতীতে কোনো সরকার এ বিচারের উদ্যোগ নেয়নি, তাই বলে ভবিষ্যতেও কেউ নেবে না—এটি কোনো যুক্তিতে পড়ে না। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিভিন্ন সংস্কারে হাত দিয়ে দেশে স্পষ্ট গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে তাদের বাধা কোথায়? এ কাজটি করলে তারা সারা দেশে, এমনকি সারা পৃথিবীতে প্রশংসা কুড়াবে। কিন্তু তারা কেন তা করতে দ্বিধা করছে, এ রহস্য আমার অজানা।
প্রতিবছর ডিসেম্বর এলে আমি আর আমি থাকি না। চোখের ওপর ভেসে ওঠে রায়ের বাজার বধ্যভূমি—আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে আলবদর-আলশামসরা আমারই প্রিয়জন শহীদুল্লাহ কায়সারকে। ডিসেম্বর মাসে আরও অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে এভাবেই ধরে নিয়ে ওরা রায়ের বাজারকে বধ্যভূমিতে বানিয়েছে। একাত্তরজুড়েই ওরা এ কাজটি নির্বিবাদে করেছে। আজকের সরকারের কাছে আমার ও আমার সন্তানসহ সব শহীদ পরিবার এবং শহীদের সন্তানদের পক্ষ থেকে জোর দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। বিচার চাই। যারা স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেছে, তাদের বিচার না করে দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এখন সময়ের দাবি। দয়া করে সরকার কি সে উদ্যোগ নেবে?