মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আসছে, তালিকা যাচাই হচ্ছে
দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন।
বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের বিদ্যমান তালিকাও যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তালিকা থেকে ‘অমুক্তিযোদ্ধাদের’ নাম স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার করে নিতে বলেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে ‘অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণ অভিযোগ ফরম’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড এখন পর্যন্ত ১১ বার বদলানো হয়েছে। অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে সাতবার।
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকে চান, রণাঙ্গনে যাঁরা বন্দুক নিয়ে সশস্ত্র লড়াই করেছেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত হবেন। অন্য যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন, নানাভাবে অবদান রেখেছেন, তাঁরা আলাদাভাবে চিহ্নিত হবেন, সম্মানিত হবেন।ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক), উপদেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা, ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য তথ্য ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ বা এমআইএস নামের একটি সফটওয়্যারে হালনাগাদ করে থাকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এমআইএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন।
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও তালিকা যাচাইয়ের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয় ফারুক ই আজমকে (বীর প্রতীক)। আর গত ২০ নভেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) পুনর্গঠন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণসহ তালিকা প্রণয়ন–সংশোধনের কাজটি করে জামুকা।
পুনর্গঠিত জামুকা গত ২৪ নভেম্বর ও ২ ডিসেম্বর দুটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে জামুকা আইন সংশোধন, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নতুনভাবে নির্ধারণ, মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ঠিক করা, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দের ব্যবহার যৌক্তিক কি না—এসব বিষয়ে আলোচনা হয়।
পুনর্গঠিত জামুকার চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব ইসরাত চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) আজিজুর রহমান বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন (অব.) নুরুল হুদা, মেজর (অব.) সৈয়দ মুনিবুর রহমান, মেজর (অব.) কাইয়ুম খান, ইসতিয়াক আজিজ উলফাত, সাদেক আহমেদ খান, হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, খ ম আমীর আলী। কমিটির সদস্য-সচিব জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন।
জামুকা আইনে কারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন, সেটি উল্লেখ রয়েছে। সেই সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম গত বুধবার তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান সংজ্ঞা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকে চান, রণাঙ্গনে যাঁরা বন্দুক নিয়ে সশস্ত্র লড়াই করেছেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত হবেন। অন্য যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন, নানাভাবে অবদান রেখেছেন, তাঁরা আলাদাভাবে চিহ্নিত হবেন, সম্মানিত হবেন। সংজ্ঞায় এসব বিষয় স্পষ্ট করা হবে। এ জন্য জামুকা আইন সংশোধন করা হচ্ছে।
অমুক্তিযোদ্ধারা বাদ পড়বেন
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, তারা নতুন করে তালিকা করেছে। এসব তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্ক তৈরি করেছে।
অর্থের বিনিময়ে অনেকে অমুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় ঢুকেছে—এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে উঠেছে। ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হওয়ায় সাবেক স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানসহ অনেকের সনদ শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে বাধ্য হয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৬ সালে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়। এটি জাতীয় তালিকা নামে পরিচিত। এরপর ১৯৮৮ সালে ৬৯ হাজার ৮৩৩ জনের আরেকটি তালিকা প্রকাশ করা হয়, যা ভারতীয় তালিকা হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তৃতীয়বার ৮৬ হাজার জনের তালিকা, ১৯৯৬–০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চতুর্থবারের মতো ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (সবুজ) হিসেবে পরিচিত। পরে আরও যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের আরেকটি তালিকা করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (লাল) হিসেবে পরিচিত।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০১–০৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে একটি কমিটি করে। এই কমিটি ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, জোট সরকারের আমলে ৭০ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের মার্চ মাসে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা (অপূর্ণাঙ্গ) প্রকাশ করা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস দিয়েও পূর্ণাঙ্গ তালিকা আর প্রকাশ করেনি। বিগত সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত বছরের মার্চ মাসে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ তালিকায় সংখ্যাটি ১ লাখ ৯০ হাজারের বেশি হবে না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গত ১৭ নভেম্বর ‘অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণ অভিযোগ ফরম’ দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। বেশির ভাগ অভিযোগে বলা হয়েছে, তালিকায় থাকা ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। প্রতারণা করে নাম তালিকায় ঢোকানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগগুলো জামুকা যাচাই-বাছাই করবে। তারপর নাম বাদ দেওয়া হবে। কারণ, মুক্তিযোদ্ধার গেজেট প্রকাশ, বাতিল সবকিছু জামুকা আইনে হয়ে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১১ ডিসেম্বর আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি (অমুক্তিযোদ্ধা) স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে চলে যেতে চান, তাহলে তাঁকে দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) দেওয়া হবে। সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। নাম প্রত্যাহার না করলে প্রতারণার দায়ে তাঁদের অভিযুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা নয়, বিদ্যমান তালিকা যাচাই-বাছাই করে সংশোধন করা হবে।
সর্বনিম্ন বয়স কত হবে
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের সংশোধিত পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যাঁদের বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল এবং যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় অন্তর্ভুক্তির আবেদন করতে পারেন। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ছিল ১৩ বছর (১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যাঁদের বয়স ন্যূনতম ১৩ বছর ছিল)। অবশ্য তারও আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে সর্বনিম্ন বয়স ছিল ১৫ বছর (১৯৭১ সালে)।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বয়স কমানো নিয়ে জামুকার সর্বশেষ দুটি বৈঠকে অনেক সমালোচনা হয়েছে। বৈঠকে আলোচনা হয়, মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়স ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করায় এখন পর্যন্ত ২৮টি মামলা হয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সর্বনিম্ন বয়স (১৯৭১ সালে) কত হওয়া উচিত, তা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ১১ ডিসেম্বরের ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, বয়স নির্ধারণ নিয়ে আদালতে মামলা আছে। মামলার রায় অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ১২ বছর ৬ মাসের কম বয়সী ২ হাজার ১১১ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছেন। তালিকা থেকে তাঁরা বাদ যাবেন।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে আরও ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। এ ছাড়া বিজয় দিবসে ৫ হাজার ও বাংলা নববর্ষে ২ হাজার টাকা ভাতা পান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের ক্ষেত্রে অবসরের বয়স ৬০ বছর। এমনিতে সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরে যাওয়ার বয়স ৫৯ বছর। এ ছাড়া সব ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দ ব্যবহারের বিধান করে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের তালিকা ও সংজ্ঞা বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত হয়েছে। তালিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে অবিশ্বাসও আছে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ও সংজ্ঞা পরিবর্তনের রাজনীতি দেশে চলতে থাকবে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা এসব পরিবর্তন করবে। পরিবর্তনের এই প্রবাহ কোনোকালে শেষ হবে না।
আফসান চৌধুরী বলেন, যে সরকারই আসুক, তারা নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা করবে। কারণ, তালিকায় নাম দেওয়া মানে হচ্ছে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের দুটি পরিসর আছে। একটি রাষ্ট্রীয়, অন্যটি সামাজিক। রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে। সমাজে মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাসের বয়ান রয়েছে, সেটা পাল্টায়নি। সেটা জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ক্ষমতার সঙ্গে নয়।