প্রথম আলো ও একটুখানি স্মৃতি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মুড়ির ঠোঙায় প্রথম পরিচয়। মুড়ি খাওয়ার পর পৃষ্ঠাটায় চোখ বোলাতে গিয়ে ভালো লেগে যায়। ছোট্ট একটা রম্য গল্প আর একটা কার্টুন ছিল পৃষ্ঠাটায়। পাশেই এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি পৃষ্ঠাটা আলপিন নামক কোনো এক ম্যাগাজিনের, যা প্রতি সোমবার প্রথম আলো পত্রিকার সঙ্গে বের হয়।

২০০৫ সালের কথা। বাড়ি থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে বাগমারা উপজেলা সদরে ভবানীগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছি। যোগাযোগের রাস্তা অতটা ভালো ছিল না। সাইকেল নিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতাম। বাড়ি থেকে নাশতার জন্য ৫ টাকা দিত। একটা শিঙাড়ার দাম ছিল ২ টাকা, মাঝেমধ্যে ঝালমুড়ি কিংবা ১ টাকা দামের নারিকেল আইসক্রিম খেতাম।

আলপিনের পৃষ্ঠাটা ভালো লাগার পর পরের সোমবারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আর সঙ্গে প্রতিদিনের নাশতার খরচ থেকে ১ টাকা, ২ টাকা করে বাঁচানো শুরু করি। এটাই উপায়, কেননা বাড়ি থেকে পত্রিকা কেনার জন্য টাকা চাইলে দেওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

পরের সোমবার প্রথমবারের মতো প্রথম আলো তথা আলপিন হাতে পাই। বাসায় গিয়ে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করি। সপ্তাহজুড়ে কয়েকবার রিভিশনসহ প্রায় মুখস্থ হয়ে যায়, তবু মন ভরে না। একই লেখা বারবার পড়ি আর পরের সোমবারের অপেক্ষা করতে থাকি। পরে আস্তে আস্তে ছুটির দিনের সঙ্গেও পরিচিত হই। এরপর থেকে শনিবার ও সোমবার করে প্রথম আলো নিতাম।

হাটবার হওয়ার কারণে সোমবার আমাদের স্কুলে মর্নিং শিফট চালু ছিল। সকাল ৯টার সময় স্কুল ছুটি হয়ে যেত। আর শহর থেকে এই মফস্‌সলে পত্রিকা আসতে অধিকাংশ দিনই ১১টা পার হয়ে যেত। আর কোনো সমস্যা হলে তো মাঝেমধ্যে ১টা, ২টাও বাজত।

স্কুল ছুটির পর বন্ধুরা সবাই চলে গেলেও আমি অপেক্ষায় থাকতাম কখন পত্রিকা আসবে। সঞ্জয় পেপার হাউসের পাশের পোস্ট অফিসের ময়লা সিঁড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি, কোনো বিরক্ত মনে হয়নি। না ছিল অ্যান্ড্রয়েড ফোন, না ছিল সময় কাটানোর জন্য ফেসবুক-ইউটিউব। কাজের মধ্যে সামনের আমগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকা কিংবা ব্যাগ থেকে আগের সোমবারের আলপিন বের করে আরেকবার রিভিশন দেওয়া। তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর পত্রিকার গাঁট থেকে যখন নতুন পত্রিকাটা পাওয়ার পর যে রকম ভালো লাগা কাজ করত, সে অনুভূতি অন্য কোনো কিছুর মধ্যে আজও পাইনি। নতুন পত্রিকার একটা আলাদা অসাধারণ ঘ্রাণ থাকে। ঘ্রাণটা একেবারেই অনন্য।

আর পত্রিকা আসার ঠিক আগমুহূর্তে সঞ্জয় পেপার হাউসের সেই টিনের ঘরে সব পত্রিকার বাগমারা প্রতিনিধিদের যেন মেলা বসত। সবাই নিজ নিজ পত্রিকার অপেক্ষায় থাকতেন। অনেকেই জানতেন আমার সেই পত্রিকা কেনার ব্যাপারটা। বিশেষ করে প্রথম আলো বাগমারা প্রতিনিধি মামুন ভাই (মামুনুর রশীদ) খুব স্নেহ করতেন।

প্রথম যেদিন সোমবারে আলপিন ছাড়া শুধু প্রথম আলোটা হাতে পেলাম, সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল। এর পর থেকে শুধু শনিবার ছুটির দিনে পড়ি আর মাঝেমধ্যে মামুন ভাইয়ের কাছে খোঁজ নিতে থাকি আলপিনের ব্যাপারে।

এক সোমবার রস+আলোর ব্যাপারে জানতে পারি। পত্রিকা কম আসার কারণে প্রথম সংখ্যাটা মিস হয়ে যায়। দ্বিতীয় সংখ্যা হাতে নিয়ে প্রথমে অতটা ভালো না লাগলেও আস্তে আস্তে পুরোনো প্রেম আলপিনকে ভুলে রস+আলোর প্রেমে পড়তে থাকি। আলপিনের চেয়ে আকার-আকৃতিতে প্রশস্ত এবং একটু অন্য রকমের রস+আলোর প্রতিও আস্তে আস্তে আসক্ত হয়ে যাই।

পোস্টকার্ড আর হলুদ খামে ভরে কিছু লেখাও পাঠাতাম সে সময়। যার অধিকাংশই ছাপা হতো না যদিও, তবু অপেক্ষায় থাকতাম নিজের নামটা রস+আলোতে দেখার জন্য।

স্মরণীয় একটা দিনের কথা আজও মনে পড়ে। পাঠকের লেখা নিয়ে রস+আলোর একটা সংখ্যা বেরিয়েছিল। সেখানে আমার একটা লেখা প্রথমবারের মতো ছাপা হয়। ছাপার অক্ষরে রস+আলোতে নিজের নামটা প্রথমবারের মতো দেখার অনুভূতি যে কতটা আনন্দের ছিল, তা বোঝাতে পারব না। বারবার লেখাটা বের করে পড়তাম, আর প্রতিবারই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করত।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করেছি। রাজধানী ঢাকা শহরে থাকি কয়েক বছর যাবৎ। আজও প্রথম আলোর সঙ্গে সেই সম্পর্কটা আগের মতোই আছে। তবে এখন শুধু সোমবার নয়, প্রতিদিন সকালে হকারের কলবেলের অপেক্ষায় থাকি। নতুন পত্রিকার সেই পুরোনো ঘ্রাণটা এখনো ভালো লাগে আগের মতোই, মনে করিয়ে দেয় সেই হারিয়ে যাওয়া পোস্ট অফিসের বারান্দায় অপেক্ষার দিনগুলো।

প্রযুক্তি হয়তো-বা অনেক কিছুই দিয়েছে—ই-পেপার, অনলাইন; কিন্তু আমার ভালো লাগাটা কোনোভাবেই কাগজের পত্রিকা থেকে সরাতে পারি না।

  • ফয়সাল আহমেদ, শিকদারী, বাগমারা, রাজশাহী