প্রত্যন্ত গ্রামের বহু পুরোনো এই হাট চালান নারীরা
সুন্দরবনঘেঁষা জনপদের নারীরা সাধারণত সাহসী ও কর্মঠ হয়। তাঁরা নৌকা বাইতে জানে, বুকসমান পানিতে দাঁড়িয়ে মাছের পোনা সংগ্রহ করে, প্রয়োজনে ছোট খাড়ি ধরে খেয়ানৌকা নিয়ে বনের ভেতর প্রবেশ করে। জ্বালানি সংগ্রহ করে আনে বন থেকে। আর আছে পানির লবণাক্ততাজনিত ক্ষত। এত কিছুর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা নারীদের সাহসটা বনকে কেন্দ্র করে। তবে তাঁরা যে আবার পুরোদস্তুর ব্যবসায়ীও হতে পারেন, সে দৃশ্য দেখা গেল সুন্দরবনঘেঁষা দাকোপ উপজেলার কৈলাসগঞ্জ ইউনিয়নের ‘বুড়ির ডাবুর হাট’-এ।
লোকমুখে শুনে গত ১৮ মে শনিবার বিকেলে এই হাটে গিয়ে দেখা গেল বেশির ভাগ বিক্রেতা নারী। এখানে স্থায়ী দোকানের চেয়ে অস্থায়ী দোকান বেশি। হাট বসে মূল সড়কের পাশ দিয়ে, পাশের নিচু স্থায়ী দোকানের সামনে এবং আরেক পাশের শ্যামাপদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। বাজুয়া, হরিণটানা, ঘোলেখাল, বোটবাড়ি, মাতৃমণ্ডপ এমন বিভিন্ন গ্রাম ও উপজেলা থেকে এখানে ব্যবসা করতে আসেন নারী বিক্রেতারা।
স্থানীয় দুই প্রবীণ যা বললেন, এর সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় এমন, ‘এ অঞ্চলের মানুষ রস সংগ্রহের জন্য তৈরি মাটির ছোট কলসকে বলে “ডাবুর”। একবার এই নদীর পাশে থুত্থুড়ে এক বুড়ি (বৃদ্ধা) ঝুঁকে নদী থেকে কিছু সংগ্রহ করছিলেন। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল শুধু তাঁর পিঠে বেঁধে রাখা মাটির কলস বা ডাবুরটি। মনে হচ্ছিল শূন্যের ভেতর শুধু কলস ওঠানামা করছে। তখন থেকে এ এলাকার নাম হয়েছে বুড়ির ডাবুর।’ এই গল্প অন্তত ২০০ বছর আগের বলে জানালেন প্রবীণেরা।
আনাজপাতি থেকে ফলমূল, হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবসা থেকে টঙের চা-দোকান—সবই সামলাচ্ছেন নারীরা। বিক্রি করছেন নিজেদের জিনিসপত্র। দরদাম করছেন, প্রয়োজনে এঁকে-তাঁকে ধমকে দিচ্ছেন। তাঁদের বিশ্বাস, ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’।
১৮ মে এই হাটে ছিলেন বাজুয়া থেকে আসা অনিতা সরকার। প্রায় ১০ কিলোমিটার দূর থেকে তিনি এসেছেন নিজের প্লাস্টিকের জুতা-স্যান্ডেলের পসরা নিয়ে। এক ক্রেতা বারবার দামাদামি করায় একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘না নিলি সইরে দাঁড়ান, পেছনে কাস্টমার।’ অনিতা জানালেন, বাড়িতেও তিনি ছোট একটি দোকান করেছেন। বাজুয়া বাজার থেকে জুতা-স্যান্ডেল কিনে এনে বিক্রি করেন। তবে রোজ সেখানে ক্রেতা থাকে না। বুড়ির ডাবুরে এই হাটবারে এক সপ্তাহের বেচাকেনা পুষিয়ে যায়। একেবারে হাট শেষ করে বাড়ি ফেরেন। তখন অন্ধকার পথ, বনের পাগল হাওয়া, নানা রকম শ্বাপদ প্রাণীর ভয় কাটিয়ে মাটির রাস্তায় টেনে চলে অনিতা সরকারের ভ্যানটি। জিনিসপত্র নিয়ে পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে সেই অন্ধকার পথ দিয়ে বাড়ি ফেরেন অনিতা।
এক দশক ধরে অনিতার বাজুয়া থেকে বুড়ির ডাবুর হাটে আসা-যাওয়া। অনেকবার ঝড়বৃষ্টির মুখে পড়েছেন। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে কোনো অপ্রীতিকর আচরণ তাঁর সঙ্গে ঘটেনি বলে জানালেন।
অনিতা সরকারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখা গেল উল্টো দিকে গাছতলায় বসা এক নারী চেঁচিয়ে কাকে যেন একটা ব্যাগ দিতে বলছেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের তাতানো গরমে তাঁর চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। কৃষ্ণা রায় নামের এই নারী ব্যবসায়ীর সংগ্রহে আছে নানা রকম সবজি। এক ক্রেতা আলু কিনেছেন, এখন ব্যাগ দরকার। পাল্লায় মেপে ক্রেতার ব্যাগে পণ্য তুলে দিয়ে টাকা নিয়ে রেখে দিলেন ছালার এক কোনা উল্টে। সেখানে উঁকি দিচ্ছে অনেকগুলো ভাংতি টাকা। তবে কৃষ্ণা রায়ের দোকানে ক্রেতা বেশি থাকায় বিশেষ পাত্তা দিলেন না আলাপের জন্য। পত্রপাঠ বিদায় নিতে হলো সেখান থেকে।
পাশে তেলেভাজা খাবারের এক দোকান চালাচ্ছেন আরেক নারী। চুলাসহ তিনি তাঁর দুই চাকার ভ্যানটি নিয়ে এসেছেন কাছের বন লাউডোব গ্রাম থেকে। তাঁর দোকানের চিংড়ির বড়া আকার অনুযায়ী ৩ থেকে ১০ টাকা করে। কিছুতেই নাম বললেন না, বরং তাঁর দোকান থেকে দুটি বড়া খাওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
কম মূল্যের ভ্যানের পোশাক, বাড়ির শাকসবজি থেকে শুরু করে ফসলের বীজ—সবই পাওয়া যায় প্রত্যন্ত এই বুড়ির ডাবুর হাটে। হাটের ক্রেতাদের মধ্যেও নারীর সংখ্যা বেশি।
বুড়ির ডাবুর হাটে ক্রেতাদের মধ্যে পাওয়া গেল হরিণটানা গ্রাম থেকে আসা আনজুয়ারা বেগমকে। তিনি জানালেন, বাড়ির পুরুষ এই সময় তরমুজের চাষ করে। তাই বাজারের দায়িত্ব পালন করতে হয়। হাটবারে একসঙ্গে অনেক কিছু পাওয়া যায়। এ সুযোগে নিজের ও বাচ্চার জন্য কিছু শখের জিনিসপত্রও কিনবেন আনজুয়ারা। আবার একাই ফিরবেন বাড়িতে। পথে অনিরাপত্তার কোনো ব্যাপার নেই বলে জানালেন পর্দানশিন এই নারী।
বিক্রেতারা জানালেন, ওয়াপদার রাস্তাটি বেশি দিন আগের নয়। কিন্তু হাট বসার প্রচলন একটু একটু করে শুরু হয়েছে অন্তত ৫০ বছর আগে। এই হাটের এক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বুড়ির ডাবুর খাল। কিছুদিন আগেও এই খাল অতিক্রম করেই সোজা সুন্দরবনে প্রবেশ করা যেত। এখন বিধিনিষেধ বেড়েছে। এই খাল ধরে যেতে যেতে একসময় পশুর নদের দেখা পাওয়া যায়।
পাশেই শ্যামাপদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চত্বরটিতেও এদিন বিকেলে মিলেমিশে বসেছিলেন নারী-পুরুষ ক্রেতা বিক্রেতারা। সেখানে আবার নদীর মাছও বিক্রি হচ্ছিল। এখানকার বিক্রেতারা জানালেন, ওয়াপদার রাস্তাটি বেশি দিন আগের নয়। কিন্তু হাট বসার প্রচলন একটু একটু করে শুরু হয়েছে অন্তত ৫০ বছর আগে। এই হাটের এক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বুড়ির ডাবুর খাল। কিছুদিন আগেও এই খাল অতিক্রম করেই সোজা সুন্দরবনে প্রবেশ করা যেত। এখন বিধিনিষেধ বেড়েছে। এই খাল ধরে যেতে যেতে একসময় পশুর নদের দেখা পাওয়া যায়।
সুন্দরবনঘেঁষা হলেও গৃহস্থালি গাছপালা খুব কম এদিকে। তবে এখানকার কথ্যরীতিতে মাধুর্য বেশি। যেকোনো কথা তাঁরা উপমা দিয়ে, সমার্থক শব্দ ব্যবহার করে বলতে পছন্দ করেন। সঙ্গে রয়েছে ভাটির দেশের ই-কারান্ত দীর্ঘ টান। সব মিলে শ্রুতিমধুর। ১৮ মে সন্ধ্যায় সারা দিনের গুমোট গরম হাওয়া কেটে সবে বাতাস উঠেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। হাটের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিলেন সরোজিনী মণ্ডল। দম নিয়ে বললেন, বিয়ের পর থেকে ৩০ বছর ধরে তিনি এই হাট দেখছেন। হাটের চা-দোকানটা শুরু করেছেন কয়েক বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর। এখন আর অতটা আতান্তর (দুরবস্থা) নেই। কিন্তু সেই নিদানকালে (বিপদের সময়) মানুষটার মুখে এতটুকু পথ্য তুলে দিতে না পারার কষ্ট তিনি একজীবনে ভুলবেন না।
সড়কের দুই পাশ দিয়ে লাইন ধরে পণ্য নিয়ে বসা নারী বিক্রেতাদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে এখানকার গ্রাম পুলিশ প্রধান (দফাদার) নীতীশ সরকার প্রথম আলোকে বললেন, ‘কয়েকজন নারী নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে প্রথমে এসে এক জায়গায় জড়ো হয়ে বসেছিলেন। তাঁদের দেখে দূরদূরান্ত থেকে অন্য নারীরাও আসতে শুরু করেন। পূজা-পার্বণ অথবা বিয়ের অনুষ্ঠানের কেনাকাটা করতে হলে পুরুষেরা চলে যান বাজুয়া বড় বাজারে। এ ছাড়া শনিবারের এই বুড়ির ডাবুর হাটেই চলে যায় স্থানীয় মানুষের। তবে এই হাটে কোনো নারীর অনিরাপত্তা বোধ করেন বলে মনে হয় না। অভিযোগ পাওয়া যায় না। ’
প্রত্যন্ত গ্রামের ভেতর এমন একটি নারীপ্রধান হাট তৈরি হওয়ায় নামটি নিয়েও আগ্রহ জাগে। স্থানীয় দুই প্রবীণ যা বললেন এর সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় এমন, ‘এ অঞ্চলের মানুষ রস সংগ্রহের জন্য তৈরি মাটির ছোট কলসকে বলে “ডাবুর”। একবার এই নদীর পাশে থুত্থুড়ে এক বুড়ি (বৃদ্ধা) ঝুঁকে নদী থেকে কিছু সংগ্রহ করছিলেন। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল শুধু তাঁর পিঠে বেঁধে রাখা মাটির কলস বা ডাবুরটি। মনে হচ্ছিল শূন্যের ভেতর শুধু কলস ওঠানামা করছে। তখন থেকে এ এলাকার নাম হয়েছে বুড়ির ডাবুর।’ এ গল্প অন্তত ২০০ বছর আগের বলে জানালেন প্রবীণেরা।
কৈলাসগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য তিমির কান্তি মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকমুখে শোনা যায়, বুড়ির ডাবুর নামটি ২০০ বছরের বেশি সময় আগের। এখানে সামাজিক শাসন আছে। বখাটেদের উৎপাত নেই। এখন শনিবারের হাটে নারীই প্রধান। তবে এদিকে পর্যটক বাড়ছে, বাইরের মানুষ আসছে, ফলে সামনে নিরাপত্তাব্যবস্থা একই রকম থাকবে কি না বোঝা কঠিন।’
হাটটি কত দিন আগের, জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল সুন্দরবন গবেষক, বাঘবিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরীর সঙ্গে। ১৯৭৪ সালে তিনি এই দাকোপ অঞ্চল দিয়ে প্রথম সুন্দরবনে প্রবেশ করেছিলেন। খসরু চৌধুরী প্রথম আলোকে বললেন, ‘বুড়ির ডাবুর নামটি তখনো ছিল, কিন্তু এ জায়গা অনেক ফাঁকা ছিল। হাট বসত কি না স্পষ্ট মনে নেই। তবে এ অঞ্চলের নারীদের সব সময়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়। আগের চেয়ে যোগাযোগব্যবস্থাও এখন উন্নত হয়েছে। ফলে প্রত্যন্ত জনপদ হলেও সেখানে নারীপ্রধান একটি হাট গড়ে উঠতেই পারে।’