রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর
মিয়ানমারের টালবাহানায় অনিশ্চিত প্রত্যাবাসন
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দূত মিশেল ব্যাশেলেতও প্রত্যাবাসনের জন্য তাদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন।
২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা বিফলে যায়।
রাখাইনে ফিরতে পাঁচ দফা শর্ত মানার দাবি রোহিঙ্গাদের।
মিয়ানমারে ১৯৭৮ সালে অপারেশন নাগা মিন বা ‘ড্রাগন কিং সেনসাস’ নামে পরিচিত সেনা অভিযান শুরু হলে মোহাম্মদ হোসেন প্রথম বাংলাদেশে আসেন। তথাকথিত ‘বিদেশি বিতাড়নে’র নামে তৎকালীন সামরিক জান্তা ওই সময় জনশুমারি শুরু করেছিল। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হলে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ভয়ে তিন মাসের মধ্যে দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে তখন রোহিঙ্গারা নিজভূমে ফিরে গিয়েছিল। কথা ছিল, রাখাইনে ফিরলে সব অধিকারই ফিরে পাবে তারা। বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। চার বছর পর ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন আনা হয়। এতে রোহিঙ্গারা আর মিয়ানমারের নাগরিক থাকল না। সবশেষ ২০১৫ সালের আইনে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়।
প্রায় তিন দশক মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কেরানি হিসেবে কাজ করেছেন মোহাম্মদ হোসেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শেষবারের মতো তিনি বাংলাদেশে এলেন। তাঁর মতে, রোহিঙ্গাদের সংকটের শুরু ১৯৭৮ সালে। সেবার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে তাঁরা স্বদেশে ফিরেছিলেন। জমি ফিরে পেলেও বাকি অধিকার তাঁদের দেওয়া হয়নি। বরং বঞ্চনা, নিষ্পেষণ থেকে একপর্যায়ে চরম নির্যাতন হয়ে ওঠে তাঁদের অনিবার্য নিয়তি।
সত্তরের কাছাকাছি বয়সী মোহাম্মদ হোসেন বলছিলেন, ‘বুড়ো হয়ে গেছি। জানি না, মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো জন্মভূমিকে দেখার সুযোগ হবে কি না! মিয়ানমারে আমার মৃত্যু হোক, এটাই চাই।’
মোহাম্মদ হোসেনের মতো কক্সবাজারের শিবিরের অধিকাংশ রোহিঙ্গাই ফিরে যেতে চান তাঁদের আদি নিবাস মিয়ানমারের রাখাইনে। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের তাতমাদো বা সেনাবাহিনীর মনোভাব কী, সেটি রোহিঙ্গা কিংবা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। তা ছাড়া গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন মিয়ানমার তো বটেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকারের তালিকায়ও নেই। রাখাইনে এমন কোনো পরিবেশ ফেরেনি, যা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাখাইনে ফিরতে উৎসাহ জোগায়। সবশেষ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দূত মিশেল ব্যাশেলেতও প্রত্যাবাসনের জন্য তাদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন। ফলে স্বদেশে ফেরাটা রোহিঙ্গাদের কাছে এখন এক অনিশ্চিত প্রত্যাশার প্রতিশব্দ।
এমন এক প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ২৫ আগস্ট। রাখাইনের মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গাদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পাঁচ বছর আগে ঠিক এই দিনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া সেনা অভিযানের পরের পাঁচ মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর আগে থেকেই আছে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। এখন পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়ায় বাংলাদেশ হতাশ কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘হতাশ হলে তো চলবে না। কাজ চালিয়ে যেতে হবে। আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এ বছরের মধ্যে ছোট পরিসরে হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই।’
রোহিঙ্গাদের ভরসা জাতিসংঘ
রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের মাত্র তিন মাসের মাথায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ চুক্তি সই করেছিল। এর নেপথ্যে ছিল চীন। আন্তর্জাতিক পরিসরে মিয়ানমার এত বেশি নিন্দিত হচ্ছিল যে চীন কোনোভাবেই চায়নি এতে বাইরের কোনো পক্ষ যুক্ত হোক। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বেঁধে দেওয়া সময়ে এক দফা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা বিফলে যায়। পরে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালে আবার প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা হলেও একই ফল হয়েছিল।
চলতি মাসে বাংলাদেশ সফরকালে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দূত মিশেল ব্যাশেলেত কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তাদের প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান। ওই সভায় উপস্থিত নারী, পুরুষ ও তরুণ মিলিয়ে অন্তত আটজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল: সরকার চীনকে নিয়ে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করছে। চীনের রাষ্ট্রদূত শিবির ঘুরে গেছেন। আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাহলে জাতিসংঘকে অনুরোধ করছেন কেন?
সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আরও অনিশ্চিত। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ফিরতে চায় তারা।
উত্তরে ওই আটজন বলেন, ‘প্রত্যাবাসন তো শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাই (ইউএনএইচসিআর) করবে। তা ছাড়া চীন বরাবরই মিয়ানমার ও সে দেশের সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে আসছে। তাই জাতিসংঘই আমাদের ভরসা।’
জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত নোয়েলিন হেজার মিয়ানমার সফর শেষে এখন বাংলাদেশ সফর করছেন। গত মঙ্গলবার কক্সবাজার শিবির পরিদর্শনের সময় রোহিঙ্গারা তাঁর কাছেও প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান।
দাবি পূরণ না হলে যাবে না রোহিঙ্গারা
২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসনের চেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার পর রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরতে পাঁচ দফা শর্ত দেয়। এর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া, রাখাইনে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেওয়া, ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং হত্যা ও নির্যাতনকারীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার। এসব প্রতিশ্রুতির বিষয়ে এখনো মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রত্যাবাসনের চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। বাংলাদেশ ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছে। মিয়ানমার যাচাই-বাছাই শেষে ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা বাংলাদেশকে দিয়ে বলেছে, তারা রাখাইনের অধিবাসী ছিল। তবে তালিকাটি অসম্পূর্ণ। আবার তালিকার সবাইকে ফেরত নেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। কারণ, ওই তালিকায় কিছু সন্ত্রাসীর নাম রয়েছে। পাশাপাশি অনেকের নামের বানানসহ নানা তথ্য অসম্পূর্ণ। ফলে এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ তালিকা ধরে কত রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠানো যাবে, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।